ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ১:৫৫:০৬ পিএম

ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক

১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৯:৩০ পিএম

অনলাইন সংস্করণ

আইএমএফের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সচেষ্ট হচ্ছে সরকার, বাড়বে ভ্যাটের চাপ

১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৯:৩০ পিএম

আইএমএফের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সচেষ্ট হচ্ছে সরকার, বাড়বে ভ্যাটের চাপ

ছবি: সংগ্রহ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি অর্থবছরেই অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ বাড়াতে বলেছে, যা অর্জনে বেশকিছু পণ্যে হ্রাসকৃত হারের সুবিধা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করছে সরকার। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই ভোক্তাদের ওপর ভ্যাটের চাপ বাড়তে পারে।

 

আন্তর্জাতিক দাতাটির নির্দেশিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে, রাজস্ব কর্তৃপক্ষ স্থানীয়ভাবে সংযোজিত মোবাইল ফোন ও রেফ্রিজারেটরের কাঁচামাল আমদানি, সংযোজন ও খুচরা বিক্রির পর্যায়ে ১৫ শতাংশ স্ট্যান্ডার্ড বা একক হারে ভ্যাট কার্যকরের কথা ভাবছে।

 

ভ্যাট ছাড় কমানোর বিস্তারিত একটি পরিকল্পনা তুলে ধরে একটি প্রস্তাব গত রোববার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে জমাও দিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।

 

বর্তমানে হ্রাসকৃত হারের সুবিধা পাচ্ছে এমন আরও আরও ২০টি পণ্যের ওপর এই হার কার্যকর হতে পারে, যারমধ্যে রয়েছে – এলপিজি সিলিন্ডার, সিমেন্ট, সমুদ্রগামী জাহাজ, বাসাবাড়ি ও শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত ক্লিনিং প্রোডাক্ট তৈরির কাঁচামাল এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্স, টেলিযোগাযোগ সরঞ্জামের মতো পণ্য।

 

রাজস্ব বোর্ডের ভ্যাট উইংয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, "আইএমএফ এর পক্ষ থেকে নতুন করে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব আদায়ের জন্য বলা হয়েছে। এই অর্থ আয়কর বা কাস্টমস থেকে আদায় করা কার্যত সম্ভব হবে না। এজন্য ভ্যাট উইং থেকে কিছু ছাড় কমিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তা আদায়ের বিষয়ে আলোচনা চলছে।"

 

তিনি বলেন, "প্রাথমিকভাবে কিছু পণ্যের (ভ্যাট) ছাড় কমানোর পরিকল্পনা ছিল। তবে এ তালিকা আরো বড় হতে পারে।"

 

"কিন্তু কোন কিছুই এখনো চূড়ান্ত নয়" – জানিয়ে তিনি বলেন, "আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সাথে আগামী ১২ ডিসেম্বর আমাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে, এরপর আমরা তালিকাটি চূড়ান্ত করতে পারব বলে আশা করছি।"

 

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, যেসব পণ্যের তালিকা করা হয়েছে, সেগুলোয় ছাড় পুরোপুরি তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফলে স্ট্যান্ডার্ড রেট বা ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। তবে স্ট্যান্ডার্ড রেট এ ভ্যাট দিয়ে ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট নেওয়ার সুযোগ থাকবে।

 

এদিকে অচিরেই কিছু ভ্যাট ছাড় প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে কর ছাড়ের এই সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।

 

মো. আবদুর রহমান খান বলেন, আমাদের উন্নয়ন সহযোগীরা দেশের ভালোর জন্যই এটা করার পরামর্শ দিচ্ছে। যেসব কর ছাড় এখনই প্রত্যাহার করা সম্ভব, সেগুলো করা হবে, তবে কোনোকিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা করব।

 

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অব্যাহতির বিষয়ে কিছু সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ (এসআরও) ইতোমধ্যেই বাতিল করা হয়েছে, শিগগিরই আরও কিছু বাতিল করা হবে। ১৫ শতাংশ একক ভ্যাট হার বাস্তবায়নকে এসময় সমর্থন করেও বক্তব্য দেন তিনি।

 

কর ছাড় কমানোর কোনো বিকল্প নেই

 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, সরকারকে অবশ্যই কর ছাড়ের পরিমাণ কমাতে হবে, এবং এর কোনো বিকল্প নেই।

 

"তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভোক্তার ব্যয় বাড়ানোরও এটা সঠিক সময় নয়। তাই সরকারের উচিৎ প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়াতে গুরুত্ব দেওয়া। ভ্যাট বা মূসক একটি পরোক্ষ কর, সেদিকে বোঝা দিলে আসলে পুরো চাপটা পড়বে ভোক্তার ওপর" - বলেন এই অর্থনীতিবিদ।

 

শিল্পসংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ

 

দেশের অন্যতম শীর্ষ ইলেকট্রনিক্স ও হোম অ্যাপ্ল্যায়েন্স প্রস্তুতকারক ফেয়ার গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে উৎপাদন ও বিক্রির বিভিন্ন পর্যায়ে যে ভ্যাট রয়েছে, তাতে ভোক্তার ওপর ভ্যাটের হার ১২ শতাংশের কিছু বেশি হয়। স্ট্যান্ডার্ড রেট এ নেওয়া হলে ভোক্তাপর্যায়ে যা প্রায় ৫ শতাংশ বাড়তে পারে।"

 

তিনি বলেন, টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে মোবাইলসহ ইলেকট্রনিক্স পণ্য, হোম অ্যাপ্লায়েন্স এর দাম এমনিতেই বেড়ে গেছে। নতুন করে দাম বাড়লে বিক্রি আরো কমে যেতে পারে। এর ফলে চোরাই মোবাইলের ব্যবহার আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

 

'হঠাৎ করেই এভাবে ভ্যাট বাড়ানো উচিত নয়' জানিয়ে তিনি বলেন , "আমাদের একটি প্ল্যান থাকে। এর ফলে পুরো বিজনেস প্ল্যান নষ্ট হয়ে যায়।"

 

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‍্যাপিড) এর চেয়ারম্যান এমএ রাজ্জাক অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করেন বলেন, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক্স বা হোম অ্যাপ্লায়েন্সের মতো পণ্যগুলোয় ভ্যাট ছাড় দেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা নেই।

 

"তাই সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি না করে- এসব পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো যেতে পারে" - বলে পরামর্শ দেন তিনি।

 

বর্তমান ভ্যাট নীতি ও ছাড়

 

বাংলাদেশে স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ। তবে, স্থানীয় শিল্পগুকে সহায়তা দিতে, সরকার প্রাথমিকভাবে ইলেকট্রনিক্স এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্সের মতো খাতে আমদানি, উৎপাদন এবং বাণিজ্য পর্যায়ে সম্পূর্ণ ভ্যাট ছাড় দিয়েছিল।

 

স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়ানো ছিল এসব ছাড়ের উদ্দেশ্য। এর বাইরে আমদানি পর্যায়ে এসব খাতে আমদানি ও আয়করের ক্ষেত্রেও ছাড় দেওয়া হয়েছে।

 

তবে গত তিন বছর ধরে কিছু ‍কিছু পণ্যের কর ছাড় পর্যায়ক্রমে কমানো হয়েছে। যার ফলে বর্তমানে কিছু পণ্যে ভ্যাটের হার ২ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত – যা 'ট্রাঙ্কেটেড রেট' নামে পরিচিত।

 

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ তাঁর উদ্বেগ তুলে ধরে বলেন, চলতি অর্থবছরের এই সময়ে করের হার বাড়ানো ঠিক হবে না। তিনি বলেন, "বাংলাদেশে করনীতির ধারাবাহিকতা ও অনুমানযোগ্যতা না থাকার বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা গভীরভাবে শঙ্কিত। তাই এসময়ে এসে পরিবর্তন করা হলে তাঁদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।"

 

অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে কর হার কমানো বিরল হলেও – এই সময়ে তা বাড়ানোর উদাহরণ আরও কম বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

 

তাঁর মতে, ভ্যাট ছাড় কমানোর পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের আগে থেকেই বিনিয়োগকারীদের সাথে যোগাযোগ করা উচিৎ, যাতে এটি কার্যকর হওয়ার আগেই তাঁরা যথেষ্ট সময় পান। ভ্যাটের প্রকৃত হার কত হবে, কতটুকু হ্রাসকৃত হার তুলে নেওয়া হবে– এসব কিছু স্পষ্টভাবে জানাতে হবে।

 

@আইএমএফের অবস্থান ও চাপ

 

আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশকে স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাট রেট বাস্তবায়নের জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। নতুন করে চলতি মাসের শুরুতে সংস্থাটির প্রতিনিধি দল এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে ছাড় তুলে দিয়ে সব খাতেই স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাট রেট চালুর জন্য চাপ দেয়।

 

২০২৩ সালের শুরুতে অনুমোদন দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ৩০টি শর্ত দেয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল প্রতিবছর দশমিক ৫ শতাংশ হারে ২০২৬ সাল পর্যন্ত জিডিপিতে করের অবদান বাড়ানো।

 

চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশ সফর করে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল। এনবিআর চেয়ারম্যানের সাথে একটি বৈঠকে এই শর্তের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন আইএমএফ কর্মকর্তারা। এসময় তাঁরা সব কর ছাড় প্রত্যাহারের ওপরও গুরুত্ব দেন। কারণ, কর ছাড়কে সরকারি ব্যয় হিসেবেই মনে করে আইএমএফ।

 

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ৪ লাখ ১০ হাজার ৪০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয় আইএমএফ। তবে গত অর্থবছরে প্রকৃত রাজস্ব আহরণ হয় প্রায় ৩ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা।

 

এই ঘাটতির কারণে, আগের দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে জিডিপির দশমিক ৬ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয় এনবিআরকে। অর্থাৎ, বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকাসহ মোট ৪ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে।

 

গত বৃহস্পতিবার এক সেমিনারে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, "আমাদের অর্থনীতি একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। আইএমএফ মিশনের সঙ্গে যখন আলোচনায় বসি, তখন দেখা যায় যে, খুবই এক্সট্রিমলি ডিফিকাল্ট পজিশনে আমরা চলে এসেছি।"

 

তিনি বলেন, "আমাদের বদনাম যে, আমরা প্রচুর কর ছাড় দেই এবং এগুলোর প্রচুর মিসইউজ হয়। আমরা যেসব অন্যায্য এক্সেম্পশন দিয়ে আসছি, এগুলো ধীরে ধীরে নয়, ড্র্যাসটিক্যালি রিমুভ করতে হবে।"

 

যেসব পণ্যে ভ্যাট বাড়তে পারে

 

মোবাইল ফোন ছাড়াও – রেফ্রিজারেটর, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, গ্রাইন্ডার, ইলেক্ট্রিক কেটলি, আয়রন, রাইস কুকার, প্রেশার কুকার, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন উৎপাদন পর্যায়ে কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভ্যাট তুলে দিয়ে ১৫ শতাংশ হতে পারে।

 

সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল চুনাপাথরের ওপর সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি বাতিল হতে পারে। সেক্ষেত্রে এর উপর ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বা সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি আরোপ হতে পারে। কেবল এর মাধ্যমেই এনবিআর আদায় করতে চায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।

 

এছাড়া এলপিজি সিলিন্ডার, সমুদ্রগামী জাহাজ, পলিপ্রোপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবার, হট-রোলড স্টেইনলেস স্টিল, ফোর স্ট্রোক থ্রি-হুইলার, অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল এর ওপরও বিদ্যমান হ্রাসকৃত হারের বদলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে পারে।

আইএমএফের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সচেষ্ট হচ্ছে সরকার, বাড়বে ভ্যাটের চাপ