ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ১১:৫৬:৫১ এএম

আগামী ৬ মাসের অর্থনীতি হবে খুব চ্যালেঞ্জিং

২৯ নভেম্বর, ২০২৪ | ২:০ পিএম

আগামী ৬ মাসের অর্থনীতি হবে খুব চ্যালেঞ্জিং

ছবি: সংগ্রহ

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সাড়ে তিন মাসে অনেক ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে আর্থিক খাতকে চাঙ্গা করতে অনেক কাজ করেছে। ব্যাংকিং খাতে অনেক সংস্কার করেছে। জ্বালানি খাতেও অনেক কাজ হয়েছে। অনেক প্রকল্প বাদ দেওয়া হচ্ছে, নতুন বড় প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রেও হাত গুটিয়ে রেখেছে। এসব উদ্যোগের ভিত্তিতে বলা যায়, সরকারের সাড়ে তিন মাসের মেয়াদে উদ্দীপনা আছে, তবে উদ্বেগও আছে। উদ্বেগের কারণ হচ্ছে-দেশের আগামী ছয় মাসের অর্থনীতি হবে খুবই চ্যালেঞ্জিং।

 

আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে না ভেবে আগামী ছয় মাস কীভাবে পার করা হবে সেটি নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে বেশি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেছেন।

 

অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংলাপে তিনি এ কথা বলেন। ইআরএফ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‌্যাপিডের আয়োজনে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বাজেটের উন্মুক্ততা নিয়ে জরিপের ফল প্রকাশ শীর্ষক অনুষ্ঠানটি বৃহস্পতিবার রাজধানীর পল্টনে অনুষ্ঠিত হয়।

 

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক। জরিপের ফল তুলে ধরেন র‌্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ। আরও বক্তব্য রাখেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আনোয়ারুল কবির ও প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইআরএফের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।

 

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলো কেন বাজেয়াপ্ত হলো না? এ সম্পদ কোথায় গেল? এই সম্পদ কেন আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার অধিগ্রহণ করল না! লুণ্ঠনকারীদের যাদের ব্যাংক ঋণ আছে সেগুলো সমন্বয়ের জন্য তাদের সম্পত্তি কেন দ্রুত সময়ের মধ্যে অধিগ্রহণ করা হলো না। এমন পদক্ষেপের কথা শোনা গেলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এটি করা গেলে আমি নিশ্চিত মানুষের মধ্যে কর দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ বাড়বে। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের যে পাহাড় গড়ে উঠেছে সেখান থেকে জনগণের সম্পদ ফিরিয়ে নিতে না পারলে কীসের বিপ্লব হলো।

 

আর্থিক খাতসহ নানা বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ আছে তবে কেন যেন উদ্বেগটা কাটছে না, এর কারণ ব্যাখ্যা করে সরকারের কাছে প্রশ্ন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, সরকার যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে তার ফল আসছে না, মানুষ অত ধৈর্য রাখতে পারছে না। কিংবা আস্থার সংকট হচ্ছে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালীন ইআরএফের এক অনুষ্ঠানে এই অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন ‘ডাল মে কুচ কালা হে’।

 

এই উদ্বৃতি গতকাল আবারও উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী রোববার বলতে পারব কোন কোন ডাল পচা, আর কোন কোন ডাল ভালো ছিল। রোববার প্রধান উপদেষ্টার কাছে শ্বেতপত্র হস্তান্তর করা হবে। পরদিন সংবাদ সম্মেলনে জনগণের জন্য গত সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরা হবে।

 

দেশের দুটি ফুসফুস ব্যাংক ও জ্বালানি খাত। এই দুই খাতে বড় ধরনের অনিয়মের কথা উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যাংক ও জ্বালানি খাতে বেশি লুটপাট হয়েছে। এসব তুলে ধরা হবে প্রতিবেদনে।

 

দুর্নীতি প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, সাধারণ মানুষের যে ধারণা আছে তার চেয়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল। এমন একটি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনো উত্তরাধিকার সরকারের করার কিছু থাকে না। ব্যাংকি খাতে সমস্যা বেশি ছিল। তাৎক্ষণিকভাবে দূর করার চেষ্টা চলছে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর যতটা উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে, তা যদি সরকার দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে না পারে তবে দেশের মানুষকে ততটাই হতাশ করা হবে। এ জন্য বছর শেষে সরকারকে পাঁচ মাসের মূল্যায়ন উপস্থাপন করতে হবে। কি কি সরকারের দিক থেকে করা হয়েছে।

 

এগুলো একত্রিত করে প্রকাশ করতে হবে। বাজেটের আগে চলমান পরিস্থিতিতে আগামী ছয় মাসের পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ, সরকারি ব্যয়, রাজস্ব আয় ও বৈদেশিক খাতের ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা তুলে ধরতে হবে। আগামী জানুয়ারিতে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার জন্য অন্তর্ভূক্তিমূলক টেকসই উন্নয়ন ফোরাম গঠন করতে পারলে আগামী বাজেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে। দেবপ্রিয় বলেন, আর্থিক স্বস্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে সংস্কার করা কঠিন হবে।

 

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর এ জন্য দরকার তারল্য পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং জ্বালানি সমস্যা দূর করা। একই সঙ্গে সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পে বেশি জোর দিতে হবে। কর আদায়ের ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

 

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার এমনভাবে রেখে গেছে যে তার খেসারত আমরা গুনছি। বেপরোয়া অনেক নীতি নিয়েছিল। ফলে মূল্যস্ফীতি হয়েছে। তিনি বলেন, এখন ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট ও চুরি বন্ধ হয়েছে। এর সুফল পাওয়া যাবে। ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ ও রফতানি বেড়েছে। বর্তমানে নেওয়া নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সাড়া দেখতে পাচ্ছি। তবে আর্থিক ব্যবস্থাপনা কঠিন হবে। কারণ আগামী ছয় মাস অত্যন্ত কঠিন সময় যাবে। এর মধ্যে রিজার্ভ বাড়াতে হবে। রিজার্ভ না বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না।

 

জরিপের ফল তুলে ধরেন র‌্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ বলেন, সরকারের ব্যয় স্বচ্ছতার সঙ্গে হচ্ছে কি না-জনগণ তা খুবই কম জানতে পারছে। জরিপের ফল তুলে ধরে তিনি বলেন, বাজেট ব্যয়ে স্বচ্ছতা ৩৭ শতাংশ। যা যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে আছে। শুধু পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। বাজেটে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ১১ শতাংশ আর বাজেট বাস্তবায়ন তদারকি হচ্ছে ৩৭ শতাংশ।

 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আনোয়ারুল কবির বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এটি কীভাবে ত্বরান্বিত করা যায় তার চেষ্টা করা হবে। জরিপে বেশ কিছু সুপারিশ এসেছে তা নিয়ে কাজ করবে অর্থ মন্ত্রণালয়।

 

প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন মাসুম বলেন, এখন প্রত্যাশা সবার বেশি। রাতারাতি মূল্যস্ফীতি কমে যাবে না। এর জন্য সময় লাগবে। তবে মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে আস্থার সংকট আছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু শুরুতে বেসরকারি খাতের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি ছিল। আর আস্থা সংকটের আরেকটি কারণ আইনশৃঙ্খলার ঘাটতি। তিনি বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার যা করতে চায় তার আগামী ছয় মাসের পরিকল্পনা মানুষকে জানালে আস্থা ফিরবে।

আগামী ৬ মাসের অর্থনীতি হবে খুব চ্যালেঞ্জিং