ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ১০:১৩:৩৭ এএম

আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নমুখিতায় ফিরেছে ভোজ্যতেলের দর

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১১:০ পিএম

আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নমুখিতায় ফিরেছে ভোজ্যতেলের দর

ছবি: সংগ্রহ

টানা দুই মাস বাড়ার পর গত নভেম্বরের পর নিম্নমুখী হয়ে ওঠে সয়াবিন তেলের আন্তর্জাতিক বাজার। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেছে টনে ৮৪ ডলার। আর পাম অয়েলের বাজারে মূল্যপতন শুরু হয় ডিসেম্বরে। জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির গড় মূল্য নেমে আসে নভেম্বরের তুলনায় ৯৯ ডলার কমে। চলতি ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেও এ নিম্নমুখী প্রবণতা বজায় রেখেছে ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজার।


বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারে মাসভিত্তিক মূল্যতালিকা পিংক শিট প্রকাশ হয়েছে গত সপ্তাহে। এতে দেখা যায়, ২০২৪ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের গড় মূল্য ছিল ১ হাজার ৯৫ ডলার। এর পর নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৪৫ ডলারে। পণ্যটির বাজারে নিম্নমুখিতা ফিরে আসে ডিসেম্বরে। এ সময় পণ্যটির টনপ্রতি মূল্য নেমে আসে ১ হাজার ৬৪ ডলারে। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে এ নিম্নমুখিতা অব্যাহত রেখে সয়াবিন তেলের গড় মূল্য নেমে আসে প্রতি টন ১ হাজার ৬১ ডলারে। শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের (সিবিওটি) সর্বশেষ বাজার লেনদেন তথ্যের ভিত্তিতে নিউইয়র্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডারের তথ্য অনুযায়ী, স্পট মার্কেটে প্রতি কেজি সয়াবিন তেলের গড় মূল্য এখন ১ ডলার ১ সেন্ট। সে অনুযায়ী, এর সর্বশেষ টনপ্রতি (১ টন = ১ হাজার কেজি) মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ১০ ডলার।


নিম্নমুখী প্রবণতায় ফিরেছে পাম অয়েলের বাজারদরও। ২০২৪ সালের অক্টোবরে অপরিশোধিত পাম অয়েলের (মালয়েশিয়া) টনপ্রতি গড় দাম ছিল ১ হাজার ৭৭ ডলার। নভেম্বর তা এক ধাক্কায় ৯২ ডলার বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৬৯ ডলারে। ডিসেম্বরে তা পৌঁছায় ১ হাজার ১৯০ ডলারে। এরপর বাজারদর নিম্নমুখী হয়ে জানুয়ারিতে তা নেমে আসে টনপ্রতি ১ হাজার ৭০ ডলারে। সর্বশেষ ৭ ফেব্রুয়ারি বুরসা মালয়েশিয়া ডেরিভেটিভস এক্সচেঞ্জে তা বিক্রি হচ্ছিল প্রতি টন ১ হাজার ১৫ ডলারে।

 

আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম এখন কমতির দিকে থাকায় শিগগিরই দেশের বাজারেও এর সুফল মিলবে বলে প্রত্যাশা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। দেশে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের বাজার প্রায় আমদানিনির্ভর। আর তা আমদানি, পরিশোধন ও বিপণনের সঙ্গে যুক্ত আছে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

 

অক্টোবরে আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ দাম বাড়লে বাংলাদেশে পণ্যটির বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে সপ্তাহের ব্যবধানে দুই দফায় শুল্ক কমায় সরকার। এরপর আমদানিকারকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়। এরপর মাস পেরোনোর আগেই আমদানিকারক মিল মালিকরা দাম আবারো বাড়ানোর জন্য একাধিকবার প্রস্তাব দেন। তবে এ দাবি গ্রাহ্য করেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এমনকি জানুয়ারিতে মিল মালিকদের সঙ্গে বৈঠকেও দাম বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এক পর্যায়ে মিল মালিকরা বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমিয়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন দিতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। যদিও বিশ্ববাজারে দাম কমার পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন রোজার আগে দাম পুনর্নির্ধারণে আগ্রহী নয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

 

ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ হয় সরকারি সিদ্ধান্তে। এতে চাইলেও মিলারদের দাম বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ নেই। আবার খোলা সয়াবিন তেল কিংবা পাম অয়েলের দাম নির্ধারিত থাকলেও পাইকারি বাজারে এসও (সরবরাহ আদেশ) বিক্রির অবাধ প্রক্রিয়ায় মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ কারণে বোতলজাত সয়াবিনের দামে পরিবর্তন না এলেও খোলাবাজারে পাম অয়েল ও সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে মিলারদের সরবরাহ করা দামে। এক মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন তেলের দাম রেড়েছে লিটারে প্রায় ১০ টাকা। সরকার দাম না বাড়ানোয় মিল মালিকরা এখন বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজারজাত কমিয়ে দিয়েছেন। সরবরাহ না থাকায় পাইকারি ও খুচরা বাজারে এখন বোতলজাত সয়াবিন তেলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

 

ব্যবহারে বৈচিত্র্য ও বাজারে প্রতিযোগিতা না থাকায় দেশে ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভর বাজার এখন বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। ভোজ্যতেলের বাজার প্রতিযোগিতামূলক না হওয়ার কারণেই বাজারে এমন পরিস্থিতি দেখা দেয় বলে মনে করছেন বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মওলা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বাজারে নতুন পণ্য আসার বিষয়ে মিল মালিকরা আমার চেয়ে ভালো বলতে পারবেন। সমস্যা হচ্ছে, মুষ্টিমেয় কয়েকটা প্রতিষ্ঠানের হাতে দেশের ভোজ্যতেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। আগে ২২টি মিল তেল সরবরাহ করত। সেখান থেকে মাত্র দুই-তিনটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে এখন নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। সারা বাংলাদেশের বাজার চলে গেছে চার-পাঁচজনের হাতে।

 

তারা যেভাবে করেন সেভাবেই চলে। এখন পাইকারি পর্যায়ে ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু যদি পাম অয়েলের দাম ধরে রাখতে চান তারা, তাহলে তাদের পক্ষে তা করা সম্ভব। কারণ সরকারের হাতে কোনো পণ্য নেই। সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে অবস্থা আরো খারাপ। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে তারা বিক্রি করছেন। আগের যেসব পণ্য আছে, সেগুলো তারা দিচ্ছেন না। আগেরগুলো সরবরাহ না করে তারা নতুনভাবে বিক্রি করছেন। দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম না কমার কারণ হলো গুটিকয়েক উৎপাদকের কাছে নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়া।’

 

সারা বিশ্বে ভোজ্যতেল ব্যবহারে বৈচিত্র্য রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অলিভ অয়েল, নারকেল তেল, সূর্যমুখী, রাইস ব্র্যান, সরিষা, পাম কার্নেল অয়েল, বাদাম, তিলসহ নানা ধরনের ভোজ্যতেলের ব্যবহার রয়েছে। একসময় বাংলাদেশে গৃহস্থালি পর্যায়ে ও খাদ্য শিল্পে কয়েক ধরনের ভোজ্যতেলের ব্যবহার দেখা গেলেও এখন তা পুরোপুরি সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলনির্ভর। দেশে মোট ভোজ্যতেলের মধ্যে ৭০ শতাংশই পাম অয়েল। মধ্যবিত্তের মধ্যে রান্নায় সয়াবিন তেলের ব্যবহার বেশি। আর খাদ্য শিল্প ও হোটেল-রেস্টুরেন্ট পাম অয়েলনির্ভর।

 

দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানিকারকরা ভোক্তাদের ঠকিয়ে বড় মুনাফা করতে চায়। বিশেষ করে রমজানসহ চাহিদা বেড়ে গেলে সরবরাহ কমিয়ে বাজারে মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি করে তারা। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে এখন সরবরাহ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। ভোজ্যতেলের সরবরাহ ও দাম নিয়ে কারসাজি বন্ধের বিষয়ে সরকারের অনতিবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’

 

আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নমুখিতায় ফিরেছে ভোজ্যতেলের দর