ঢাকা শনিবার, ৫ জুলাই, ২০২৫ - ৬:৫৭:১১ এএম

ঋণসহ নানামুখী সংকটে জর্জরিত ব্যবসা-বাণিজ্য

১৮ জানুয়ারি, ২০২৫ | ৪:১২ পিএম

ঋণসহ নানামুখী সংকটে জর্জরিত ব্যবসা-বাণিজ্য

ছবি: সংগ্রহ

ব্যাংকঋণ নিয়ে শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায় বিনিয়োগ করে ঋণের জালে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন অনেক উদ্যোক্তা। একের পর এক রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক অসন্তোষ, বৈশি^ক মহামারী করোনার প্রভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ব্যাংকঋণের সুদহার বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট ও মূল্যস্ফীতির মতো একের পর এক কারণে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় অনেক ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছেন। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আবার ঋণের টাকা অন্যত্র বিনিয়োগ নতুবা আত্মসাৎ করে ইচ্ছাকৃতভাবেই ঋণখেলাপি হয়েছেন।

 

এসব অসৎ ও অদক্ষ ব্যবসায়ীর কারণে বিপদে পড়ছেন সৎ ও প্রকৃত ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে দেশে বিনিয়োগ না করে আত্মসাৎ ও বিদেশে টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার ফলে ব্যাংকগুলোও রুগ্ন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সৎ ও প্রকৃত ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকার এবং ব্যাংকগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এটি ব্যাংক খাতে মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ।



বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। এর তিন মাস আগে অর্থাৎ গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা বা ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।

 

গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা বা ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। সেই হিসাবে ৯ মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে গত সেপ্টেম্বর শেষে আদায় অযোগ্য তথা মন্দ ঋণের স্থিতি বেড়ে হয়েছে ২২ হাজার ৪০২ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত জুনে এ ধরনের ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা বা ৮৫ দশমিক ১১ শতাংশ।

 

তবে ব্যবসায়ীদের জন্য কিছুটা স্বস্তির খবর হচ্ছে- তাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিলের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মাধ্যমে ডাউন পেমেন্টের শর্ত শিথিল, সুদ মওকুফ ও ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে। তবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা এ সুযোগ পাবেন না। পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছভাবে করতে বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের একটি যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি সাম্প্রতিক আন্দোলন, অগ্নিকা-, করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ প্রকৃত ক্ষতির মুখে পড়া ২০ কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণে বিশেষ পুনঃতফসিলের প্রস্তাব কমিটির কাছে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে শিগগির নীতিমালা জারি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 

জানা গেছে, আইএমএফের ঋণ নেওয়ার কারণে গত বছর থেকে কঠিন শর্ত মানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া অনেক ঋণ এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে। আগের মতো বিশেষ সুবিধা বন্ধ হয়েছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ দ্রুত বাড়ছে। এদিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ক্রেডিট মেয়াদ পুনরায় বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর

 

বিটিএমএ জানায়, এটি প্রাথমিক টেক্সটাইল খাতের সর্ববৃহৎ সংগঠন। এর সদস্য সংখ্যা ১৮৫০। এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বেসরকারি খাতে একক বিনিয়োগ হিসাবে সর্বাধিক। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০-৮৬ শতাংশ অর্জিত হচ্ছে টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল খাত থেকে, যার ৭০ শতাংশের জোগানদাতা টেক্সটাইল খাত এবং এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিটেনশন প্রায় ৩০ শতাংশ। তাই বিটিএমএর সদস্য মিলগুলো বর্তমানে আমদানি পরিপূরক শিল্প হিসেবে বিবেচিত।

 

বিটিএমএর চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ইউক্রেন-রাশিয়া ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানা কারণে ২৫০ শতাংশ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিকের বেতন ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক অসন্তোষ, প্রয়োজনীয় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে মিলগুলো উৎপাদন সক্ষমতার ৫০-৬০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না। রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিসহ উৎপাদনমুখী শিল্পসমূহ কাঁচামাল আমদানিকালে বিনিময়হারজনিত ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এসব কারণে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সুযোগ চায় সংগঠনটি। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সুবিধার্থে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ক্রেডিট মেয়াদ পুনরায় বৃদ্ধির দাবিও জানানো হয়েছে বিটিএমএর চিঠিতে।

 

এদিকে নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্স ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পসহ সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে ধাক্কা আসবে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এর প্রভাব পড়বে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও। ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক গতিতে না চললে ব্যাংকঋণ পরিশোধ করা কঠিন হবে। এতে ঋণখেলাপি আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, গেল কয়েক বছরের ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশের অর্থনীতি। এর মধ্যে আবার নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্স ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এ খাতকে বিষিয়ে তুলবে। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ আত্মঘাতী বলেও মনে করছেন তারা।

 

নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পসহ সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একের পর এক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ছে। লোকসানে চলছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্স ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি আরও সংকট তৈরি করবে। ফলে অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হতে পারেন। তাই ঋণখেলাপি আরও বৃদ্ধি পাবে বলেই শঙ্কা হচ্ছে।

 

 

তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, একদিকে যখন ক্রমেই ভারী হচ্ছে ঋণের সুদ, অন্যদিকে তখন ভ্যাট, ট্যাক্স ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। কর্মসংস্থানের অন্যতম অবলম্বন শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর বাড়ছে বোঝা। এতে করে কর্মসংস্থানের ওপরও আঘাত পড়ছে, যা পুরো দেশের জন্য অশুভ। তাই ব্যবসায়ীদের ওপর বোঝা না বাড়িয়ে ব্যবসাবান্ধব নীতি সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

ঋণসহ নানামুখী সংকটে জর্জরিত ব্যবসা-বাণিজ্য