ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৩:১১:০৪ পিএম

কমছে বিনিয়োগ কর্মসংস্থান স্থবির

২০ জানুয়ারি, ২০২৫ | ৭:০ পিএম

কমছে বিনিয়োগ কর্মসংস্থান স্থবির

ছবি: সংগ্রহ

স্থিতিশীলতা আসছে না দেশের অর্থনীতিতে। ঠিক একইভাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতিরও তেমন কোনো উন্নতি নেই। বরং দিনকে দিন বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। একরকম হাত গুটিয়ে বসে রয়েছেন উদ্যোক্তারা। বর্তমানে যেকোনো খাতে বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন তারা। ফলে নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় থমকে আছে নতুন কর্মসংস্থান। এ অবস্থার মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততাসহ বিভিন্ন রকম সংকট, দফায় দফায় ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার মতো সমস্যার কারণে অনেক শিল্প কারখানা বন্ধও হয়ে যাচ্ছে। এতে বাড়ছে বেকারত্বের হার।

 

এদিকে গত শনিবার রাজধানীর বিআইসিসিতে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আয়োজিত ‘শ্বেতপত্র এবং অতঃপর : অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক যে সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়, তাতে দেশের অর্থনীতি খুবই নাজুক বলে উল্লেখ করেছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদরা। তারা দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়েও অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, প্রবৃদ্ধির হার ধীর হয়ে পড়ছে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সংকট দেখা যাচ্ছে। ফলে দেশ একটা মধ্যমেয়াদি ফাঁদে ঢুকে পড়েছে।

 

দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিনিয়োগ পরিস্থিতি, কর্মসংস্থানের যে নাজুক অবস্থার কথা শোনা যাচ্ছে, বাস্তবচিত্র তার চেয়ে আরও বেশি খারাপÑএ মন্তব্য করে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘নতুন বিনিয়োগ এখন নেই বললেই চলে। দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীই এখন দেশে নতুন বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে দশবার ভাবছেন। এর কারণ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এখন দেশের ক্ষমতায় অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক সরকার নেই।

 

দু মাস পর, ছয় মাস পর বা এক বছর পর দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, দেশে কি দ্রুত নির্বাচিত সরকার আসবে, নাকি নির্বাচিত সরকার আসতে দেরি হবে, এসব অনেক কিছু নিয়েই ভাবছেন উদ্যোক্তারা। কেননা রাজনৈতিক সরকার দ্রুত এলে উদ্যোক্তা ধরে নেয় মোটামুটি পাঁচ বছর আর রাজনৈতিক অস্থিরতা হবে না। তখন পরিবেশও বিনিয়োগের উপযোগী থাকবে মনে করেন উদ্যোক্তারা এবং বিনিয়োগ বাড়ান। এখন সে রকম পরিস্থিতি না থাকায় বিনিয়োগ কম হচ্ছে। আর নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মস্থানের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।’

 

দেশে যে বিনিয়োগ কমছে তার চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা বিডার তথ্যে। বিডার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালের পর থেকেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। এমনকি সরকার পরিবর্তনের পরও বিনিয়োগে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। বিডার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ১ হাজার ৮৩টি ব্যবসা প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৩৩৪ কোটি ৫১ লাখ ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধন হয়েছে। পরের বছর ১ হাজার ৮১টি ব্যবসা প্রকল্প নিবন্ধনের মাধ্যমে ১ হাজার ২৮৮ কোটি ৩৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছিল। ২০২৩ সালে আরও কমে ব্যবসার ৯৯৮টি প্রকল্পে ৮৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলার হয়। আর ২০২৪ সালে ব্যবসার ৭৪২টি প্রকল্পে ১ হাজার ১৬৩ কোটি ডলার বিনিয়োগ নিবন্ধন হলেও এপ্রিল-জুন প্রান্তিকেই ২৫৪ প্রকল্পে ৬৬৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকার পরিবর্তনকালীন জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা কমে ১৮৬ প্রকল্পে মাত্র ১৮৬ কোটি ৭১ লাখ ডলার হয়।

 

অপরদিকে বিনিয়োগের বাস্তবচিত্র ফুটে ওঠে প্রধান উপাদান মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাস জুলাই-নভেম্বরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। এতেই দেশে নতুন বিনিয়োগ কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

 

দেশের উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিতে দেশে দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে ব্যবসার পরিধি। মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টায় দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়ানোয় ব্যাংকঋণের সুদ অনেক বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। আর দুর্বল অর্থনীতির সূচকে আটকে গেছে ব্যবসার গতি। সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এবং আকাশচুম্বী সুদের চাপে পড়েছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান।

 

এ বিষয়ে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা ও বাংলাদেশ চেম্বার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের এখন আগের ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে, নতুন বিনিয়োগ কীভাবে করবে। কারণ শিল্প কারখানায় চাহিদামাফিক গ্যাস-বিদ্যুৎ মিলছে না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে। ডলারের বাজার এখনও টালমাটাল। বিগত কয়েক মাসের দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে এবং বহুমুখী সংকটে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই এ পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারা এখন আগের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার লড়াই করছেন, নতুন বিনিয়োগ নিয়ে ভাবছেন না।’

 

ধারাবাহিকভাবেই কমছে বিনিয়োগ

 

জানা যায়, আয় ফেরত আনার ভোগান্তি, অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের নেট ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) বা বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নেট এফডিআই প্রবাহ ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এফডিআই প্রবাহ কমেছে ১৪২ মিলিয়ন ডলার।

 

বাড়ছে বেকারের হার

 

সম্প্রতি বিবিএসএর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশে বেকারের হার বাড়ছে। বিদায়ি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শ্রমশক্তির ২৬ লাখ ৬০ হাজার মানুষ বেকার ছিলেন। এতে বলা হয়, দেশের কর্মে নিয়োজিত বা শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় বেকার লোকের সংখ্যা বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ২০২৪ সালের শুরুতে বেকার মানুষ কম থাকলেও বছর শেষে ধারবাহিকভাবে এ সংখ্যা বেড়েছে। একই সময়ে কৃষি, সেবা এবং শিল্প, সব খাতেই কর্ম হারিয়ে বেকার হয়েছে অনেক মানুষ। নারীর চেয়ে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেশি বেড়েছে বলে উঠে এসেছে জরিপে।

 

২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিএস। এতে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে ২৬ লাখ ৬০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সালের এ সময়ে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। এর অর্থ আগের বছরের তুলনায় এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি।

 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে, বেকার জনগোষ্ঠী মূলত তারাইÑযারা পূর্ববর্তী ৭ দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে একঘণ্টা কাজ করারও সুযোগ পাননি এবং পরবর্তী এক মাস ধরে কাজ খুঁজেছেন; কিন্তু মজুরির বিনিময়ে কোনো কাজ পাননি। বিবিএস এ নিয়ম অনুসারেই বেকারের হিসাব দিয়ে থাকে। বিবিএসের হিসাব অনুসারে, গত সেপ্টেম্বর মাস শেষে দেশে পুরুষ বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৯০ হাজার, আর নারী বেকার ৮ লাখ ৭০ হাজার।

 

২০২৩ সালের একই সময়ে পুরুষ বেকার ১৬ লাখ ৪০ হাজার, আর নারী বেকার ছিল ৮ লাখ ৫০ হাজার। সেই হিসাবে পুরুষ বেকার বেড়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার এবং নারী বেকার বেড়েছে ২০ হাজার। বিবিএস বলছে, শ্রমশক্তিতে এখন ৫ কোটি ৯১ লাখ ৮০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। অথচ ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে ছিল ৬ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা কমেছে ১৯ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫ কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত। বাকিরা বেকার।

 

বিনিয়োগ আকর্ষণে ১৯ খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বিডা

 

এদিকে তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ মোট ১৯টি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কাজ করবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। এ জন্য সংস্থাটি একটি হিটম্যাপ অর্থাৎ গতিশীল পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বিডার পক্ষ থেকে এ হিটম্যাপ বা পরিকল্পনা পাঠানো হয়েছে গণমাধ্যমে। এতে জানানো হয়, সংস্থাটি দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণে আরও কার্যকরভাবে কাজ করবে।

 

বিডা বলেছে, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ কম এবং গত কয়েক বছর ধরে তা একটি স্থির প্রবণতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গত দুই অর্থবছরে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কমেছে।

 

বিডার হিটম্যাপে প্রাথমিকভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১৯টি খাতকে চিহ্নিত করে এসব খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য কাজ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খাতগুলো হচ্ছে তৈরি পোশাক, বস্ত্র (অ্যাডভান্সড টেক্সটাইল ও টেকনিক্যাল টেক্সটাইল), নবায়নযোগ্য জ্বালানি, চামড়া, অটোমোবাইল ও এর সরঞ্জাম, ওষুধ, প্লাস্টিক, হালকা প্রকৌশল, জুতা, ইলেকট্রনিকস, সেমিকন্ডাকটর, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, খেলনা, চিকিৎসা সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, তথ্যপ্রযুক্তি, সরবরাহ ও এপিআই।

কমছে বিনিয়োগ কর্মসংস্থান স্থবির