ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
৬ জানুয়ারি, ২০২৫ | ১০:৪৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ
কমেছে শুঁটকি উৎপাদনের হার
৬ জানুয়ারি, ২০২৫ | ১০:৪৫ এএম
![কমেছে শুঁটকি উৎপাদনের হার](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2025/01/06/20250106104541_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে হুমকির মুখে মিঠা পানির মাছের চলনবিলের শুঁটকি শিল্প। চলতি মৌসুমে অন্যান্য বছরের তুলনায় কমেছে উৎপাদন।
বর্তমানে চলনবিলের দেশীয় মাছের শুঁটকির দাম আকাশ ছোঁয়া। এ পরিস্থিতিতে অবৈধ জালের বহুল ব্যবহার এবং নিষেধাজ্ঞার সময়ে ডিমসহ মা মাছ শিকারের ফলে বিল অঞ্চলে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এদিকে রাক্ষুসে মাছ বেড়ে যাওয়ায় বিলে দেশীয় মাছের পরিমাণ কমেছে বলে জানায় উপজেলা মৎস্য অফিস।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, আশ্বিন থেকে মাঘ মাসকে বলা হয় দেশীয় মাছের শুঁটকি তৈরির মৌসুম। এ বছর উপজেলায় দেশীয় মাছের শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে ২২০ টন, যা গত বছর ছিল ৩০৭ টন। তা ছাড়া এ বছর খাল-বিলে রাক্ষুসে বোয়াল মাছের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ছোটজাতের দেশীয় প্রজাতির মাছের সংকট দেখা দিয়েছে।
চলনবিলকে বলা হয় মাছের উন্মুক্ত প্রজননক্ষেত্র। বর্ষায় বিলে পানি ঢোকা শুরু হলে নতুন পানিতে ডিম ছাড়তে ঝাঁকে ঝাঁকে মা মাছ আসে। ঠিক এ সময়টিতেই ডিমসহ মা ও পোনা মাছ ধরতে চায়না দুয়ারি জাল, সুতি জালসহ নানা অবৈধ জাল পেতে রাখেন অসাধু জেলেরা। এসব জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে অসংখ্য রেণুপোনাও। এতে আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে দেশীয় মাছের উৎপাদন হার।
চলনবিল অঞ্চলে এ বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত বাউত উৎসব বা পোলো উৎসবেও সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, পাবনার চাটমোহর ও নাটোরের সিংড়ায় মেলেনি মাছ। ফলে পণ্ড হয়েছে উৎসব। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দলবেঁধে এ উৎসবে যোগ দেওয়া মানুষগুলো ফিরে গেছে খালি হাতে। বিষয়টিকে বিল অঞ্চলের জেলেদের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন স্থানীয় সচেতন মানুষ।
এদিকে শুঁটকির চাতাল মালিকদের ভাষ্য, চলনবিলে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে দেশীয় মাছের পরিমাণ। পাঁচ বছর আগেও ৮-১০ লাখ টাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে মৌসুমি শুঁটকি ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব ছিল। তখন মাছের দাম যেমন কম ছিল, তেমনি জোগানও ছিল পর্যাপ্ত। বর্তমানে এ ব্যবসায় পুঁজি বাড়াতে হয়েছে প্রায় তিনগুণ। পাশাপাশি মাছের অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় ও চাহিদামাফিক মাছের সরবরাহ না থাকায় এ ব্যবসা লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩ কেজি কাঁচা পুঁটি মাছ রোদে শুকিয়ে ১ কেজি শুঁটকি পাওয়া যায়। ৫ কেজি বোয়াল মাছে ২৫০-৩০০ গ্রাম শুঁটকি হয়। ৪ কেজি শোল শুকিয়ে পাওয়া যায় ৭৫০-৮০০ গ্রাম শুঁটকি। এ ছাড়া শুঁটকি তৈরিতে মাছ ও লবণ কেনা, ধোয়া, রোদে শুকাতে শ্রমিক খরচ, বাজার থেকে মাছ কেনা ও শুঁটকি বিক্রির সময় পরিবহন খরচ মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের লাভের পরিমাণ খুবই কম।
উপজেলার মহিষলুটি এলাকার শুঁটকির চাতাল মালিক মো. নান্নু হোসেন জানান, বর্তমানে চলনবিলে দেশীয় মাছের আকাল। দুই দশক আগেও চলনবিল অঞ্চলের ১০টি উপজেলায় শুঁটকির চাতাল ছিল তিনশত-সাড়ে তিনশত-এর মতো।
বর্তমানের শুঁটকির বাজার দর নিয়ে তিনি জানান, সৈয়দপুরের বিখ্যাত শুঁটকির মোকামে এ মৌসুমে ২৫০-৩০০ গ্রাম ওজনের বোয়াল মাছের শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৪৮ হাজার টাকা, টাকি মাছের শুঁটকি ৩৬ হাজার টাকা, পুঁটি মাছের শুঁটকি ২৪ হাজার টাকা, শোল মাছের শুঁটকি ৬৮ হাজার টাকা ও চান্দা মাছের শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ১৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতিমণ ছোট ইচা বা দেশীয় চিংড়ির শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ২০ হাজার টাকার মধ্যে।
বর্তমানে চলনবিল অঞ্চলের হাটবাজার ও মাছের আড়তে শুঁটকি তৈরির উপযোগী ২৫০-৩০০ গ্রাম ওজনের ১ কেজি বোয়াল মাছের দাম ৪৫০-৫০০ টাকা, প্রতি কেজি ৩৫০-৪৫০ গ্রাম ওজনের শোল মাছের দাম ৫৫০-৬০০ টাকা, পুঁটি মাছ ৪০-৫০ টাকা, টাকি মাছ ২৫০-৩৫০ টাকা, চান্দা মাছ ২৫০-৩০০ টাকা এবং ছোট ইচা বা দেশীয় চিংড়ি প্রতি কেজি ৬৫০-৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ কয়েক বছর আগেও বর্তমানের তুলনায় প্রজাতিভেদে প্রতি কেজিতে মাছের দাম ৯০-২৫০ টাকা কম ছিল।
নওগাঁ জিন্দানী ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক ও তাড়াশ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সনাতন দাস জানান, মৎস্য ভান্ডারখ্যাত চলনবিলে অসাধু মৎস্যজীবীরা কারেন্ট জাল ও বিশেষ করে চায়না দুয়ারি জাল পেতে দেশীয় প্রজাতির মাছ শিকার করে। ফলে বিলে দেশীয় মাছের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। এসব জালের কারণে নানা জলজ প্রাণী পর্যন্ত বিলুপ্ত হতে চলেছে। এ কারণেই শুঁটকি ব্যবসায়ীদের মাছের সংকট দেখা দিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় চলনবিল পরিবেশ ও প্রকৃতি আন্দোলনের সভাপতি মো. এমরান আলী রানার সঙ্গে। তিনি জানান, চলনবিল রক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। পাশাপাশি উপজেলা মৎস্য অফিস ও ইউনিয়ন কার্যালয় থেকে মানুষের কাছে চলনবিলের প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষার বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। মাছ শিকারের সবধরনের অবৈধ ফাঁদ বন্ধ করতে পারলে পোনা মাছ নিধন ও অন্যান্য জলজপ্রাণী রক্ষা করা সম্ভব। এটি আমাদের দায়িত্ব।
তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মশগুল আজাদ জানান, বর্তমানে শুঁটকি চাতালে কিছুটা দেশীয় প্রজাতির মাছ কম পাওয়ার কারণ হলো এ বছর বোয়াল মাছের সংখ্যা খুবই বেশি। বোয়াল রাক্ষুসে মাছ। ছোট ছোট মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে। তাই এ মাছগুলো ছোট মাছ খায়। এ কারণেই দেশীয় জাতের মাছ কিছুটা কম।
![কমেছে শুঁটকি উৎপাদনের হার](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)