ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৬:৫৯:০৮ এএম

খাদ্য সংকটে রুগ্‌ণ মহিষের কমে যাচ্ছে দুধ উৎপাদন

৩ মে, ২০২৪ | ১০:৫৭ এএম

খাদ্য সংকটে রুগ্‌ণ মহিষের কমে যাচ্ছে দুধ উৎপাদন

তাপপ্রবাহ ও বৃষ্টির অভাবে চারণভূমিতে লবণাক্ত পানির পরিমাণ বেড়েছে। এ কারণে কমেছে ঘাস। কমেছে মিষ্টি পানিও। ফলে খাদ্য সংকটে পড়েছে মহিষ। দেখা দিচ্ছে রোগবালাই। কমে যাচ্ছে মহিষের ওজন ও দুধ উৎপাদন। খামার মালিকরা জানান, মহিষের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে, যা সম্প্রতি সংকটে পড়েছে।


জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ভোলার ছোট-বড় ৩২টি চর ও বিভিন্ন বনাঞ্চলে ১ লাখ ২৪ হাজার মহিষ রয়েছে। এর মধ্যে ভোলা সদর উপজেলায় ১৪ হাজার ৯৬০, দৌলতখান উপজেলায় ৮ হাজার ৩১১, বোরহানউদ্দিন উপজেলায় ১৩ হাজার ২৯৮, তজুমদ্দিন উপজেলায় ৬ হাজার ৬৪৯, লালমোহন উপাজেলায় ১২ হাজার ৩০৮, চরফ্যাশন উপজেলায় ৫২ হাজার ১৯৩ ও মনপুরা উপজেলায় ১৬ হাজার ২৮৪টি মহিষ রয়েছে। প্রতি বছর মহিষের দুধ উৎপন্ন হয় ১৫ হাজার ৪০ টন। এসব মহিষ থেকে লক্ষাধিক মানুষ বছরে আড়াই-তিন কোটি টাকা আয় করেন। মহিষের দুধ, দই, পনির স্থানীয়দের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

 

লোকালয়ে ঘাসের অভাব এবং জায়গা সংকটের কারণে বিভিন্ন চর ও বনাঞ্চলের চারণভূমিতে পালন করা হয় মহিষ। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় আর শীত উপেক্ষা করে মহিষ বিভিন্ন দল বা বাথানে বিভক্ত হয়ে আকাশের নিচে সার্বক্ষণিক অবস্থান করে খাবার খায়। গত এপ্রিলের তাপপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাত না হওয়ায় চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন বনাঞ্চলের ছোট ছোট খাল-বিলে পানি কমে অনেকাংশ শুকিয়ে গেছে। এতে দেখা দিয়েছে পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা। এ লবণাক্ত পানি খেয়ে রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে বহু মহিষের শরীরে। তাছাড়া তাপপ্রবাহে চরাঞ্চলের ঘাস শুকিয়ে গিয়ে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।

 

বেসরকারি এক সংস্থার মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে খাদ্যের অভাবসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে জেলায় শতকরা ১৪ ভাগ মহিষ মারা গেছে। এরপর বন্যা ও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কিছু মহিষসহ মারা গেছে বিভিন্ন গবাদিপশু। সম্প্রতি জেলার কোথাও মহিষের মৃত্যুর খবর পাওয়া না গেলেও অধিকাংশ চরসহ বিভিন্ন স্থানের মহিষগুলো প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাব ও মিঠা পানির সংকটে রোগা হয়ে যাচ্ছে।

 

একটা সময় চরাঞ্চলে ঘাসের কোনো অভাব ছিল না। এখন প্রতিটি চরের মাটিতে ফসল আবাদ হওয়ায় কমে গেছে মহিষের চারণভূমি। এ তথ্য জানিয়ে চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছালাম পাটওয়ারী বলেন, ‘প্রায় ২৫ বছর আগে চরে ২০টি মহিষ লালনপালন শুরু করি। সেই ২০টি মহিষ থেকে এখন আমার ২৫০টির বেশি মহিষ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মহিষ পালনে অনেকটা বেগ পেতে হচ্ছে। চরে আগের মতো ঘাস না থাকায় পশু লালনপালন করতে খুবই সমস্যা হচ্ছে। তাছাড়া মিঠা পানির অভাবে নদীর লবণাক্ত পানি খেয়ে অধিকাংশ মহিষের স্বাস্থ্য কমে অনেকটা রোগা হয়ে গেছে। এর সঙ্গে কমে গেছে দুধ উৎপাদন।’

 

একই ইউনিয়নের জালাল বেপারী বলেন, ‘‌আমার ২০০ মহিষ থেকে কমে এখন রয়েছে ১৬০টি। কয়েক বছর আগেও মহিষের মধ্যে এত রোগবালাই ছিল না। ইদানীং খাবার ও মিঠা পানির অভাবে রোগবালাই হয়ে মহিষ দুর্বল ও রোগা হয়ে যাচ্ছে। আবার দুর্বল শরীরের কারণে অতি জোয়ারের পানিতে মহিষ অন্যত্র ভেসে যাচ্ছে। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ালেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না।’

 

একটি খামারের মালিক ফারুক মিয়া বলেন, ‘‌মনপুরার চর কালকিনিতে আমার প্রায় ১৫০ মহিষ রয়েছে। এসব মহিষ থেকে প্রতিদিন ছয়-সাত মণ দুধ হতো। কয়েক মাস ধরে দুধ উৎপাদন একেবারে কমে গছে। দৈনিক দেড়-দুই মণের বেশি এখন আর দুধ হয় না। কেননা চরে আগের মতো পর্যাপ্ত ঘাস নেই। তাছাড়া লোনা পানি খেয়ে মহিষের মধ্যে ছড়াচ্ছে রোগবালাই। এতে মহিষ পালনে এখন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে।’

 

ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের মেঘনা নদীর মাঝে জেগে ওঠা মাঝের চরে প্রায় ২০ হাজার গবাদিপশু রয়েছে। তবে এখানে আবাসস্থলের সংকট রয়েছে। প্রয়োজনীয় মাটির কিল্লা (উঁচু স্থান) না থাকায় প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে মহিষগুলোকে দীর্ঘ সময় গলাসমান পানির মধ্যে ডুবে থাকতে হয়।

 

অন্যদিকে মনপুরা উপজেলার বিচ্ছিন্ন উপদ্বীপ চরনিজামে দেখা যায়, নদীর পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় মহিষ মালিকরা গ্রামের পুকুরের পানি মহিষকে খাওয়াচ্ছেন। এভাবে শত শত মহিষ পুকুরটিকে মানুষের ব্যবহার অনুপযোগী করে তুলছে। ওই পুকুরের দূষিত পানি ব্যবহার করতে গিয়ে সেখানকার মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়াসহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

 

চারণভূমিতে পুকুর কেটে মাটির কিল্লা তৈরি করে দিলে অন্তত মহিষের নিরাপত্তা এবং মিষ্টি পানির অভাব পূরণ হবে বলে মনে করেন গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন মহিন। তিনি বলেন, ‘‌মহিষ পালন চরাঞ্চলের মানুষের কাছে একটি লাভজনক সম্পদ। এ সম্পদের নানা সমস্যা সমাধানে সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।’

 

চরাঞ্চলে মিঠা পানি ও ঘাস সংকটের কথা স্বীকার করে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘‌জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে মহিষ পালনের সুবিধার্থে বেশকিছু মাটির কিল্লা তৈরির জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশা করি, এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে একদিকে মহিষের আবাসস্থল হিসেবে তৈরি হবে মাটির কিল্লা, অন্যদিকে মাটির কিল্লার চারপাশে তৈরি হবে পুকুর। এতে মহিষের খাওয়ার জন্য বিশুদ্ধ পানির অভাব হবে না।’

 

খাদ্য সংকটে রুগ্‌ণ মহিষের কমে যাচ্ছে দুধ উৎপাদন