ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৮:৩০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
গৃহযুদ্ধের এক দশকে সিরিয়ার অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে প্রায় ৮০%
১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৮:৩০ পিএম
![গৃহযুদ্ধের এক দশকে সিরিয়ার অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে প্রায় ৮০%](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2024/12/13/20241213143721_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
গৃহযুদ্ধ শুরুর বছর ২০১১ সালে সিরিয়ার অর্থনীতির আকার ছিল ৬১ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন (৬ হাজার ১৩৯ কোটি) ডলারের সমপরিমাণ। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, এক দশকেরও বেশি সময় গৃহযুদ্ধ চলাকালে ২০২২ সালে দেশটির মোট জিডিপি নেমে এসেছে সাড়ে ১২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন (১ হাজার ২৪০ কোটি) ডলারে। সে অনুযায়ী, এ সময় দেশটির অর্থনীতির সংকোচন হয়েছে ৭৯ দশমিক ৮০ শতাংশ।
একসময় সিরিয়ার অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি ছিল জ্বালানি তেল উত্তোলন ও রফতানি। গৃহযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২০১১ সালে দেশটির দৈনিক অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন সক্ষমতা ছিল ৪০ কোটি ব্যারেলেরও বেশি। ২০২০ সালের মধ্যে সেটি নেমে আসে ৫ কোটি ব্যারেলেরও নিচে।
গৃহযুদ্ধের বছরগুলোয় ক্রমেই রুগ্ণ থেকে রুগ্ণতর হয়েছে একসময়ের সমৃদ্ধ দেশ সিরিয়ার অর্থনীতি। অতীতে কখনেই অপুষ্টির সম্মুখীন না হওয়া দেশটির নাগরিকদের দৈনিক খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বাশার আল-আসাদ সরকারের শেষ সময় এসে অর্থাভাবে সেনাসদস্য ও সরকারি কর্মীদের বেতনও বকেয়া হয়ে পড়েছিল। এ অর্থনৈতিক দৈন্যদশাই বাশার আল-আসাদের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
যুদ্ধের আগে সিরিয়ার জিডিপির অর্ধেকের জোগান আসত জ্বালানি তেল ও কৃষি খাত থেকে। যুদ্ধের কারণে এ দুই খাতেই ধস নেমেছে। জ্বালানি তেলের নিট রফতানিকারক দেশ সিরিয়াকে এ সময় নিজস্ব চাহিদা পূরণের জন্য পণ্যটি আমদানিও করতে হয়েছে। আমদানি বাড়াতে হয়েছে কৃষিপণ্যের। লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ায় বিধ্বস্ত হয়েছে অর্থনীতি। গত বছরের ভয়াবহ এক ভূমিকম্পের কারণেও দেশটিকে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়তে হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০০০ থেকে ২০১০ সময়ে সিরিয়ার অর্থনীতি গড়ে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময়ে মূল্যস্ফীতিও ছিল নিয়ন্ত্রণে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের আগে দেশটির আমদানি ও রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল জিডিপির ৭৬ দশমিক ৫ শতাংশে। অর্থনৈতিক এ প্রবৃদ্ধির সুবাদে দেশটির দারিদ্র্যের হারও কমেছিল সেই সময়। ২০০৬-০৭ সময়ে জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ দিনে ৩ ডলার ৬৫ সেন্টের কম আয় করত। মাত্র ২ দশমিক ৮৩ শতাংশের আয় ছিল ২ ডলার ১৫ সেন্টের কম। ২০২২ সালের হিউম্যানিটারিয়ান নিডস অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামের (এইচএনএপি) সমীক্ষা অনুসারে বর্তমানে দেশটির ২৭ শতাংশ বা ৫৭ লাখ মানুষ দিনে ২ ডলার ১৫ সেন্টের নিচে আয় করছে এবং ১ কোটি ৪৫ লাখ বা ৬৯ শতাংশ মানুষের আয় ৩ ডলার ৬৫ সেন্টের কম।
দীর্ঘ ১৪ বছরের যুদ্ধের প্রভাবে সিরিয়ার অবকাঠামোর পাশাপাশি অর্থনীতিও বিধ্বস্ত অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশটির ৬৬ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ৫৬ লাখ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সিরিয়ার জিডিপি সংকুচিত হয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। ২০১১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে দেশটির স্থানীয় মুদ্রা সিরিয়ান পাউন্ডের বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৭০ গুণ। স্থানীয় মুদ্রার এ অবমূল্যায়নের ফলে দেশটির মূল্যস্ফীতিও লাগাম ছাড়িয়েছে। ২০২৩ সালে দেশটির মূল্যস্ফীতি ৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ বছর শেষে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০০ শতাংশে পৌঁছবে বলে প্রক্ষেপণ করেছে বিশ্বব্যাংক। গত কয়েক বছরে সিরিয়ার সরকার জ্বালানি তেল ও কৃষি খাতে ভর্তুকি কমিয়েছে। এ সময়ে দেশটির রাজস্ব আয় কমার বিপরীতে বেড়েছে বাজেট ঘাটতি।
সিরিয়ার মানুষের দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির (আইআরসি) করা এক সমীক্ষায়। আইআরসির সমীক্ষা অনুসারে, যুদ্ধকবলিত উত্তর সিরিয়ার ৮৫ শতাংশের বেশি মানুষ ঋণগ্রস্ত এবং এ ঋণগ্রস্তদের ৯০ শতাংশেরই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নেই। ৬০ শতাংশ মানুষকে খাবার কিনতে হয় ঋণ করে। দেশটির ১ কোটি ৬৫ লাখের বেশি মানুষ বা মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কোনো না কোনোভাবে খাদ্যের জন্য মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। যুদ্ধের কারণে দেশটির অধিকাংশ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে, মৌলিক সেবাগুলো প্রায়ই অনুপস্থিত এবং অর্থনীতির পতনের ফলে ৯০ শতাংশ মানুষই দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। সেখানকার বাসিন্দাদের কাছে থাকা প্রাণিজ পণ্য, শস্য, কৃষিজ পণ্য, মাছ, পশুসম্পদ থেকে শুরু করে জ্বালানি বা গ্যাস হাতের কাছে যা আছে তাই বিক্রি করে আয় করতে হচ্ছে।
এ অবস্থায় তাদের বাধ্য হয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করতে হচ্ছে এবং একই সঙ্গে পুষ্টিকর ও বিভিন্ন ধরনের খাবার জোগাড় করতে তাদের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। আইআরসির গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে যুদ্ধের আগে অপুষ্টির বিষয়টি প্রায় অস্তিত্বহীন হলেও বর্তমানে ২০ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির বিষয়টিকে তাদের বাড়ন্ত বয়সের সন্তানদের জন্য বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি এবং খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে সিরিয়ানদের দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। অনেকেই তাদের সন্তানদের শিশুশ্রমে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম ঠিকভাবে চালাতে পারছে না।
![গৃহযুদ্ধের এক দশকে সিরিয়ার অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে প্রায় ৮০%](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)