ঢাকা শনিবার, ৫ জুলাই, ২০২৫ - ১০:১৫:২৪ পিএম

গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের কার্যক্রম এক বছর ধরে স্থবির

১২ আগস্ট, ২০২৪ | ৯:৭ এএম

গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের কার্যক্রম এক বছর ধরে স্থবির

ছবি: সংগ্রহীত

কয়লা আমদানিনির্ভর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরে প্রায় এক বছর ধরে কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে। ভারতীয় কয়লার দাম বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা আমদানি করছেন না। সেই তুলনায় ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানীকৃত কয়লা দামে সাশ্রয়ী।

 

 

ব্যবসায়ীরা জানান, ভারত থেকে আমদানি করা কয়লায় টনপ্রতি লোকসান গুনতে হচ্ছে ৪-৫ হাজার টাকা। ক্রেতা না থাকায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টন মজুদ কয়লা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। এছাড়া কাঁচা ইট পোড়ানোর মৌসুম শেষ হওয়ায় বর্তমানে কয়লার চাহিদাও নেই। ফলে বন্দরে জমেছে কয়লার স্তূপ। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি বেকার হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার শ্রমিক। এ অবস্থায় বন্দর দুটির কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে।

 

 

বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারত থেকে ৬৯ হাজার ৬০০ টন কয়লা আমদানি করা হয়েছিল। তবে সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাত্র ৯৬৪ টন কয়লা আমদানি করা হয়েছে।

 

 

আশরাফুল ইসলাম নামের স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘ভারতীয় কয়লার দাম বেশি হওয়ায় লোকসান গুনতে হয়। আবার আমদানি না করলেও ব্যবসায়িক খরচ ও কর্মচারীদের বেতন দিয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের পক্ষে বেশিদিন ব্যবসা পরিচালনা সম্ভব হবে কিনা বুঝতে পারছি না।’

 

 

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর দিয়ে শুধু কয়লা আমদানি চালু থাকলেও এ দুটি বন্দরকে ২০২৩ সালের ১১ মার্চ পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর ঘোষণা করে সরকার। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়, ভেবেছিলেন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ এ এলাকার গুরুত্ব বেড়ে যাবে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হলেও শুধু কয়লা ছাড়া কোনো পণ্য আমদানি-রফতানি শুরু হয়নি। অথচ এক সময় শুধু কয়লা আমদানির মাধ্যমেই জমজমাট ছিল বন্দর দুটি। ফলে হতাশ হয়ে পড়েছে স্থানীয়রা।

 

 

মিন্টু নামের একজন কয়লা ব্যবসায়ী জানান, ভারতীয় কয়লা উন্নত মানের এবং দামে বেশি। আগে সব ইটভাটার মালিকরা ভারতীয় কয়লা দিয়ে ইট পোড়াত। এখন ইন্দোনেশিয়ার কয়লার দাম কম হওয়ায় সেখান থেকে আমদানি করা কয়লা দিয়ে ইটভাটায় কাজ করা হয়।

 

 

তিনি বলেন, ‘আমরা লোকসান দিয়ে কয়লা বিক্রি করলেও ক্রেতারা আসছেন না। কারণ ইন্দোনেশিয়ান কয়লা দামে অনেক কম। ১৫-১৭ হাজার টাকা টন কয়লা পাওয়া যায়। এজন্যই আমাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

 

 

স্থানীয় একটি ইটভাটার মালিক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমরা আগে ভারতীয় কয়লা দিয়ে ইট পোড়াতাম। এখন ভারতীয় কয়লার দাম বেশি, তাই কয়েক বছর ধরে ইন্দোনেশিয়ার কয়লা ব্যবহার করছি।’

 

 

গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বন্দর দুটি দিয়ে ভারত থেকে ৬৯ হাজার ৬০০ টন কয়লা আমদানি করা হয়। আমদানীকৃত এসব কয়লা টনপ্রতি দাম ২১-২২ হাজার টাকা। বিক্রি করতে হয় ২৩-২৪ হাজার টাকা দরে। ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় দাম বেশি হওয়ার কারণে আমদানিকারকরা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কয়লা আমদানি করেন না। শুধু লাইসেন্স ঠিক রাখতে কিছু কয়লা আমদানি করে থাকেন তারা। সেজন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুই বন্দর দিয়ে কয়লা আমদানি করা হয়েছে মাত্র ৯৬৪ টন।

 

 

বর্তমান বাজারে ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা এক টন কয়লার দাম ১৬ হাজার টাকা। ভারত থেকে আসা এক টন কয়লার দাম পড়ে ২০-২২ হাজার টাকা। ভারতীয় কয়লার দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতাদের আগ্রহ নেই। ফলে ভারত থেকে বেশি দামে কয়লা আমদানি করে এবং ক্রেতা না থাকায় লোকসানের মুখে পড়েছেন দুই বন্দরের অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী।

 

 

সম্প্রতি দুটি স্থলবন্দর ঘুরে দেখা গেছে, গোবরাকুড়া-কড়ইতলী বন্দরে ভারতের সড়কের ফটক বন্ধ রয়েছে। দুটি বন্দরে সুনসান নীরবতা, নেই কোনো কর্মযজ্ঞ। গোবরাকুড়া বন্দরের প্রবেশপথ ধরে এগিয়ে গেলে দেখা যায় দুই পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে কয়লা। কিন্তু কোনো ক্রেতার দেখা নেই। তবে দু-একটি চা দোকান খোলা রয়েছে। সেখানে একজন ব্যবসায়ী ও একজন শ্রমিক নেতার সঙ্গে কথা হয়।

 

 

গোবরাকুড়া স্থলবন্দর শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি নূরউদ্দিন বলেন, ‘মূলত দুই বন্দর দিয়ে শুধু কয়লা আমদানি করা হয়। দুই বন্দরে শ্রমিক রয়েছেন ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার। এক বছর ধরে বন্দরে কোনো কাজ নেই। পরিবার নিয়ে দুই বেলার খাবার জোগাড় করতে প্রায় সবাই দিনমজুরি করে চলছে।’

 

 

গোবরাকুড়া বন্দরের মেসার্স সুমি এন্টারপ্রাইজের মালিক মাঈন উদ্দিন বলেন, ‘২০২৩ সালে আমরা ভারত থেকে কয়লা এনেছি। টনপ্রতি খরচ পড়েছে ২১-২২ হাজার টাকা। এখন ক্রেতারা দাম বলে টনপ্রতি ১৬ হাজার টাকা। কারণ ইন্দোনেশিয়ার কয়লা ক্রেতারা ১৬ হাজার ৫০০ টাকা টনপ্রতি কিনতে পারছেন। এখন টনে তো ৪-৫ হাজার টাকা লোকসানও দিতে পারছি না। তাই নতুন করে কোনো ব্যবসায়ী ভারত থেকে কয়লা আমদানি করছেন না।’

 

 

তিনি আরো বলেন, ‘দুই বন্দরে এক বছর ধরে প্রায় ২০-২৫ হাজার টন কয়লা অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এ কয়লায় সবাই টাকা বিনিয়োগ করে লোকসানে পড়েছেন।’

গোবরাকুড়া-কড়ইতলী আমদানি-রফতানি গ্রুপের মহাসচিব অশোক সরকার বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া থেকে কম দামে দেশে কয়লা আমদানি হয়। তার তুলনায় ভারত থেকে কয়লা আমদানি করতে বেশি টাকা লাগে। যে কারণে এ বন্দর দিয়ে কয়লা নিতে ক্রেতাদের আগ্রহ নেই। ক্রেতা না থাকলে তো ব্যবসায়ীরা কয়লা আমদানিতে আগ্রহ দেখাবেন না। তাই এক বছর ধরে ভারত থেকে কয়লা আমদানি করা হচ্ছে না। যারা আগে এনেছিলেন, তারা কয়লা নিয়ে লোকসানে পড়েছেন।’

 

 

বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক (গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের দায়িত্বে থাকা) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারত থেকে ৬৯ হাজার ৬০০ টন কয়লা আমদানি করা হলেও গত অর্থবছরে ৯৬৪ টন কয়লা আমদানি করা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে কম দামে দেশে কয়লা আমদানি হওয়ায় দুই বন্দরের ব্যবসায়ীরা ভারতীয় কয়লায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে দুই বন্দরের কার্যক্রম অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে।’

 

গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের কার্যক্রম এক বছর ধরে স্থবির