ঢাকা শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০২৫ - ৮:০৩:৫১ পিএম

গ্যাস সংকট নিয়ে বিপাকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র

৩১ অক্টোবর, ২০২৪ | ১০:৩৫ এএম

গ্যাস সংকট নিয়ে বিপাকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র

ছবি: সংগ্রহ

বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় প্রতিদিন গ্যাস প্রয়োজন ১২০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ হয় প্রায় ৯২ কোটি ঘনফুটের মতো। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের এ অসামঞ্জস্য চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সরবরাহ না থাকায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এখন গ্যাসের বড় ও অত্যাধুনিক ব্যয় সাশ্রয়ী কেন্দ্রগুলো চালু রাখতে পারছে না। 


এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবির কর্মকর্তাদের ভাষ্য হলো পেট্রোবাংলার বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখার মতো প্রয়োজনীয় গ্যাসের সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে লোডশেডিং করতে হয়।


জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর গ্যাস সরবরাহ বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া রয়েছে। এ অর্থের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। বিপিডিবি ও গ্যাসভিত্তিক আইপিপিগুলোর কাছে আটকে থাকা এ বকেয়া পাওনা নিয়ে বিতরণ কোম্পানিগুলো কোনো ধরনের আশ্বাসও পাচ্ছে না। উচ্চ মূল্যে এলএনজি কিনে সরবরাহ করে অর্থ পাওয়া না গেলে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই তাদের কাছে। আবার বিদ্যুতের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারাও বলছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ বিপিডিবির কাছে কেন্দ্রগুলোর যে পরিমাণ অর্থ বকেয়া পড়েছে, সে টাকা না পেলে তারা গ্যাসের দাম পরিশোধ করতে পারছেন না।

 

 

পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ পায় বিতরণ কোম্পানিগুলো। এ অর্থ দীর্ঘ সময় ধরে বকেয়া থাকায় পর্যাপ্ত গ্যাস আমদানি করা যাচ্ছে না। বিষয়টি সমাধানে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুতে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে নারাজ পেট্রোবাংলাও।’

 

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সংকটে থাকায় গত কয়েকদিন ১ হাজার ১৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে বিপিডিবিকে। এ লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুতের গ্রাহকদের তীব্র ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রীষ্ম মৌসুমে এ ভোগান্তি চরম পর্যায়ে উঠে যায়। দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ১২ হাজার ৩৮৪ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে গ্যাসপ্রাপ্তি সাপেক্ষে গড়ে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে বিপিডিবি। বাকি সক্ষমতা চালু না থাকায় অন্যান্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেক্ষেত্রে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও হয় বেশি।

 

 

ঘাটতি গ্যাসের কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় রেশনিং করতে হচ্ছে। সেখানে কখনো কখনো গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বর্তমানে যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালানো যায়। তবে আসছে শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কমে গেলে এ সরবরাহ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যাবে বলে আশা করা যায়।’

 

 

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে পেট্রোবাংলার গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর পাওনা এ পর্যন্ত ১৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সার কারখানা ও আবাসিকসহ অন্যান্য খাতে পাওনা বকেয়া এরই মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার ঘরে দাঁড়িয়েছে। এ অর্থ না পাওয়ায় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব নয় বলে বিতরণ কোম্পানি ও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

 

সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বৃহৎ ও ছোট মিলিয়ে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ৭১টি। এর মধ্যে ৩৩টি বন্ধ (শাটডাউন) রয়েছে। বিপিডিবি বলছে, গ্যাস না থাকায় এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না।

 

সরবরাহ ঘাটতির কারণে বসিয়ে রাখা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বৃহদায়তনের আছে তিনটি। এগুলোর মোট সক্ষমতা ১ হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট। এ তিন বিদ্যুৎ কেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে দৈনিক ৩২ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস প্রয়োজন। এর মধ্যে সামিটের মেঘনাঘাটে স্থাপিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (সামিট মেঘনাঘাট-২) সক্ষমতা ৫৮৩ মেগাওয়াট। ইউনিক মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ৫৮৪ মেগাওয়াট। বর্তমানে কাগজে-কলমে এ দুটি কেন্দ্র বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে রয়েছে। কিন্তু গ্যাসের অভাবে কেন্দ্র দুটি এখন বন্ধ রয়েছে। তৃতীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র জেরা মেঘনাঘাট ৭১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বর্তমানে টেস্টিং-কমিশনিং কার্যক্রম চলছে। 

 

অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাশ্রয়ী করতে সার্বক্ষণিক চালু থাকবে (বেইজলোড) এমন পরিকল্পনা থেকে মেঘনঘাটে সামিট-ইউনিক ও জেরার তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত হলেও এখন এসব কেন্দ্রের গ্যাসের জোগান নিশ্চিত করতে পারছে না বিপিডিবি। অথচ গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখা গেলে ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমিয়ে রাখা যেত।

 

গ্যাস সরবরাহের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, ‘বিদ্যমান গ্যাস সরবরাহের বাইরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বাড়তি গ্যাস সরবরাহের জন্য তিতাসের সিস্টেমে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ নেই। যে কারণে তিতাসও গ্যাস সরবরাহ দিতে পারছে না। এছাড়া বিপিডিবি ও আইপিপিগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের বকেয়া রয়েছে। এ অর্থের পরিমাণ ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এ অর্থ আদায় না হওয়ায় পেট্রোবাংলাকে তিতাস অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। অর্থের কারণে তিতাসে পরিচালন ব্যয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

 

পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, তিতাসের আওতাধীন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় চালাতে প্রতিদিন গড়ে ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। তবে বিপিডিবির চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে গেলে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দরকার হয়। যেখানে বর্তমানে ২১ কোটির কিছু বেশি গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছে তিতাস। তবে বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে এর বাইরে আপাতত গ্যাস সরবরাহ বাড়বে না।

 

 

গ্যাস সরবরাহ কম থাকায় তিতাসের আওতাধীন ঘোড়াশালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, সামিট-ইউনিক ও জেরার তিনটি ১ হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট, অ্যাগ্রিকো ১৪৫, সিদ্ধিরগঞ্জ ১২০, হরিপুরে দুটি ৫১২ মেগাওয়াট, সামিট মেঘনাঘাট ৩৩৫, ডরিন পাওয়ারের টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহে একই সক্ষমতার দুটি ৪৪ মেগাওয়াট, হরিপুরের ৩৬০ ও রিজেন্টের ১০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাস সংকটে বন্ধ রয়েছে।

 

 

পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে পেট্রোবাংলা বর্তমানে ২৮৬ কোটি ঘনফুটের কিছু বেশি গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে। গ্যাস সংকটের কারণে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। বিগত কয়েক বছর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অব্যাহতভাবে গ্যাস সংকটে রয়েছে। স্থানীয় উৎসে পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় অবকাঠামো সক্ষমতা ও অর্থ সংকটের কারণে এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ বাড়াতে পারছে না পেট্রোবাংলা।

গ্যাস সংকট নিয়ে বিপাকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র