ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৯:৪৩:৫৬ এএম

চট্টগ্রাম বন্দর: ৫,০০০ কন্টেইনারের শিডিউল বিপর্যয়, পরিবহন ধর্মঘটে বিপর্যস্ত আমদানি-রপ্তানি

গত মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় গাড়ি পার্কিংয়ের জের ধরে চট্টগ্রাম ডিসি পার্কের গার্ড ও পণ্য পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কর্মবিরতিতে যায় চট্টগ্রাম জেলা প্রাইম মুভ

৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৯:০ পিএম

চট্টগ্রাম বন্দর: ৫,০০০ কন্টেইনারের শিডিউল বিপর্যয়, পরিবহন ধর্মঘটে বিপর্যস্ত আমদানি-রপ্তানি

ছবি: সংগ্রহ

টানা তিন দিনের পরিবহন ধর্মঘটের কারণে রপ্তানি পণ্যবাহী এবং খালি ১,৭৫৬ টিইইউ কন্টেইনার না নিয়েই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে গেছে চারটি কন্টেইনারবাহী জাহাজ। ফলে শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে অন্তত ৫,০০০ রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনারে। অন্যদিকে, আমদানি পণ্যের ডেলিভারি না হওয়ায় বন্দরের ইয়ার্ডে জমেছে অতিরিক্ত আরও ৫,০০০ আমদানি কন্টেইনার।

 

দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশই পরিচালিত হয় আমদানি-রপ্তানির প্রধান সামুদ্রিক গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে– ধর্মঘটের কারণে যার কার্যক্রম প্রায় সম্পূর্ণ স্থগিত হয়ে পড়ে।

 

গত মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় গাড়ি পার্কিংয়ের জের ধরে চট্টগ্রাম ডিসি পার্কের গার্ড ও পণ্য পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কর্মবিরতিতে যায় চট্টগ্রাম জেলা প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়ন। এর ৩ দিন পর শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) রাত ৮টার দিকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে কাজে ফেরেন শ্রমিকরা।

 

আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরে একের পর এক প্রাইম মুভার চালক এবং মালিকদের ধর্মঘট এবং কর্মবিরতির কারণে ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। শ্রমিকদের অযাচিত কর্মসূচি ও প্রশাসনিক অবহেলার ফলে পণ্য পরিবহনে সৃষ্ট এই অচলাবস্থা ব্যবসায়ীদের জন্য বাড়িয়ে দিয়েছে বাণিজ্যিক ক্ষতি, রপ্তানি পণ্যের শিডিউল বিপর্যয়, জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইমসহ স্টোর রেন্টের চাপ।

 

রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন শিল্প কারখানা থেকে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য চট্টগ্রামের ১৯টি বেসরকারি ডিপোতে আনা হয়। ডিপোতে কন্টেইনার বোঝাই করে সেগুলো শিডিউল অনুযায়ী জাহাজে তোলা হয়।

 

চট্টগ্রামের বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো থেকে প্রতিদিন ২,০০০ থেকে ২২০০ টিইইউ রপ্তানি কন্টেইনার জাহাজীকরণের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। কন্টেইনারগুলো জাহাজে তুলে সিঙ্গাপুর, কলম্বোসহ বিভিন্ন ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ইউরোপ আমেরিকায় পৌঁছায়।

 

কিন্তু তিনদিন পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় ডিপো থেকে ৫,০০০ এর বেশি রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার বন্দরে যেতে পারেনি। এর ফলে ডিপোগুলোতে তৈরি হয়েছে রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনারের জট।

 

ডিপো মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইংল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল আমিন সিকদার টিবিএসকে বলেন, "টানা তিনদিন পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকার ঘটনা নজিরবিহীন। এর প্রভাবে ডিপোগুলোতে রপ্তানিপণ্য তিনদিন বন্দরে পাঠানো যায়নি।

 

তিনি বলেন, "১৯টি ডিপোতে স্বাভাবিক সময় ৮,০০০ টিইইউ রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার থাকে। শুক্রবার রাত ৮টায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের সময় এই সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩,০০০।"

 

তিনি আরও বলেন, "ধর্মঘটের কারণে কন্টেইনার জাহাজে না উঠাতে পারায় এর ফলে যে শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে, এটি স্বাভাবিক হতে আরও অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগে যাবে।"

 

পোশাক রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, রপ্তানি পণ্য সময়মতো জাহাজে উঠাতে না পারলে সেগুলো নির্ধরিত সময়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছে না। তখন রপ্তানি পণ্যে ডিসকাউন্ট, শিপমেন্ট বাতিলসহ নানান জটিলতায় পড়তে হয়।

 

চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের তথ্য অনুযায়ী, ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি ৮৩৯ টিইইউ রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনার এবং ৯১৭ টিইইউ খালি কন্টেইনার না নিয়ে ছেড়ে গেছে চারটি জাহাজ।

 

চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক এর নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হক টিবিএসকে বলেন, "পরিবহন ধর্মঘটের কারণে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। একটি জাহাজ জেটিতে প্রবেশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমদানি কন্টেইনার নামিয়ে রপ্তানি কন্টেইনার বোঝাই করে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করে। চলমান সংকটে অতিরিক্ত একদিন অপেক্ষা করেও বুকিং থাকা রপ্তানি পণ্যবাহী এবং খালি কন্টেইনার বোঝাই করা সম্ভব হয়নি।"

 

"একদিন অতিরিক্ত সময় লাগায় বাড়তি চার্জই শুধু নয়, বন্দরে জাহাজের জট পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে," যোগ করেন তিনি।

 

পরিবহন শ্রমিক মালিকদের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সহ বিভিন্ন পাইকারি মার্কেটের অন্তত ১০,০০০ পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল করে। এরমধ্যে বন্দরের পণ্য পরিবহন করে প্রায় ৭,০০০ প্রাইমমুভার, কাভার্ডভ্যান, ট্রাক। একদিন পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকলে সড়কে তৈরি হয় তীব্র যানযট। সেটি স্বাভাবিক হতে লেগে যায় আরও কয়েকদিন।

 

সবশেষ গত ৪ ফেব্রুয়ারি ডিসি পার্কে শ্রমিকদের মারধরের ঘটনায় টানা তিনদিন পণ্য পরিবহন প্রায় বন্ধ থাকায় বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। রমজানের আগে এই ঘটনায় দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।

 

ধর্মঘট প্রত্যাহার

শুক্রবার রাত ৮টার দিকে শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে জেলা পুলিশ কমিশনার (বন্দর) আশ্বাস দিলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন শ্রমিকরা।

 

এরপর পণ্যবাহী পরিবহন কার্যক্রম শুরু হয়। শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বন্দরে পুরোমাত্রায় শুরু হয় পণ্য পরিবহনের কাজ।

 

চট্টগ্রাম জেলা প্রাইম মুভার ও ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পদাক আবুল খায়ের টিবিএসকে বলেন, "আমরাও পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে কোনো কর্মসূচি দেওয়ার পক্ষপাতি নই। প্রশাসন কিংবা মালিক পক্ষকে দাবির বিষয়ে বার বার অবহিত করার পরও যখন আমাদের দাবিগুলোকে অগ্রাহ্য করা হয়, তখন বাধ্য হয়ে আমরা এ ধরনের কর্মসূচি দেই।"

 

"ডিসি পার্কের ইস্যুটিও এরকমই ছিল। প্রশাসন চাইলে শ্রমিকদের ওপর হামলার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারতো," যোগ করেন তিনি।

 

এর আগে, মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় গাড়ি পার্কিং করা নিয়ে ডিসি পার্কের গার্ড ও পণ্য পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ধর্মঘটের ডাক দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রাইম মুভার অ্যান্ড ট্রেলার ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। শ্রমিকরা ডিসি পার্ক বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানান। অন্যদিকে, ধর্মঘটের কারণে কার্গো পরিবহন ব্যাহত হয় এবং বন্দরে সৃষ্টি হয় কন্টেইনার জট।

 

এর পরিপ্রেক্ষিতে, শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। প্রাথমিকভাবে আশ্বাসের পরে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কিন্তু পরের দিন বুধবার ডিসি পার্ক পুনরায় খোলা হলে, ফের ধর্মঘটে যান শ্রমিকরা।

 

অচলাবস্থা নিরসনে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বন্দর বিভাগের উপ-কমিশনার শ্রমিক সংগঠনের পাঁচজন প্রতিনিধির সঙ্গে আরও আলোচনায় বসেন। শেষ পর্যন্ত, ডিসি পার্ক বন্ধ থাকবে বলে আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা পুনরায় কার্যক্রম শুরু করেন।

 

এদিকে, ডিসি পার্ক স্থায়ীভাবে বন্ধ করার বিরোধিতা করছে জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, "আমরা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ডিসি পার্ক সাময়িকভাবে তিন দিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছি। স্থায়ীভাবে বন্ধের প্রশ্নই আসে না। আমরা কেন ডিসি পার্ক বন্ধ করব?"

 

শ্রমিকদের চারটি মূল দাবির মধ্যে রয়েছে— হামলাকারীদের গ্রেপ্তার, আহতদের চিকিৎসা ও যথাযথ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, ডিসি পার্কে যাওয়ার বিকল্প পথ তৈরি করা এবং সড়কে শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

চট্টগ্রাম বন্দর: ৫,০০০ কন্টেইনারের শিডিউল বিপর্যয়, পরিবহন ধর্মঘটে বিপর্যস্ত আমদানি-রপ্তানি