ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ১১:৩৬:০৯ এএম

চীন-যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধের স্পুটনিক ডিপসিক!

৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ | ৯:৪৮ এএম

চীন-যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধের স্পুটনিক ডিপসিক!

ছবি: সংগ্রহ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাব হয় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের। ১৯৫৫ সালে চার দিনের ব্যবধানে দুই দেশই ঘোষণা দেয়, তারা মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও বাকি বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে জায়গা করে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১। শুরু হয় ‘স্পেস রেস’।

 

প্রায় ৭০ বছর পর, আরেক স্নায়ুযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ব। বিংশ শতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধে যেমন মহাকাশ প্রযুক্তি মুখ্য হয়ে উঠেছিল, বিশ্লেষকদের মতে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এবারের যুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। এই যুদ্ধের স্পুটনিক হয়ে আবির্ভূত হয়েছে স্বল্প-পরিচিত চীনা স্টার্টআপ ‘ডিপসিক’-এর এক এআই মডেল।

 

২০২২ সালের নভেম্বরে ওপেনএআই ‘চ্যাটজিপিটি’ লঞ্চ করার পর থেকে মার্কিন কোম্পানিগুলোই এআইয়ের দৌড়ে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। গুগলের ‘জেমিনাই’, মেটার ‘লামা’, মাইক্রোসফটের ‘কোপাইলট’, অ্যানথ্রপিকের ‘ক্লড’-সহ বেশ কিছু উচ্চ কার্যকারিতা-সম্পন্ন এআই মডেল বাজারে এসেছে গত আড়াই বছরে।

 

এই দৌড়ে যেন চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ধরতে না পারে, সে জন্য ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাইডেন প্রশাসন এক নতুন আইন করে। এনভিডিয়াসহ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে এআই নির্মাণে প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক চিপগুলো চীনে রফতানি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

 

কিন্তু গত ২০ জানুয়ারি ডিপসিক বাজারে আনে বিশেষায়িত এআই মডেল আর১। এক সপ্তাহের মধ্যে চ্যাটজিপিটিকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপল স্টোরের সর্বোচ্চ রেটিংধারী অ্যাপলিকেশন হয়ে উঠেছে ডিপসিক। ডিপসিকের আর১ ও ভি৩-দুটি মডেলই চ্যাটজিপিটি, জেমিনাইয়ের মতো পশ্চিমা মডেলগুলোর সমান, কিছু ক্ষেত্রে আরও ভালো কার্যক্ষমতা প্রদর্শন করছে।

 

স্কেল এআইয়ের সিইও আলেকজান্ডার ওয়াং সিএনবিসিকে বলেন, আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, ডিপসিকের পারফরম্যান্স শীর্ষস্থানীয় মার্কিন এআই মডেলগুলোর সমতুল্য। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত চ্যাটবট অ্যারেনার এআই র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষ ১১-র ভেতর অবস্থান ডিপসিকের দুই মডেল। সেখানে ইলন মাস্কের ‘গ্রুক’ ও অ্যানথ্রপিকের ‘ক্লড’ এর চেয়ে এগিয়ে আছে তারা।
ডিপসিকের দাবি অনুযায়ী, তাদের নতুন মডেলের প্রশিক্ষণে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫৬ লাখ মার্কিন ডলার। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ এআই মডেলগুলোর তৈরির পেছনে ১০ থেকে ১০০ কোটি ডলার খরচ হয় বলে দাবি করেছেন অ্যানথ্রপিকের সিইও ডারিও আমোদেই।

 

স্বল্পোন্নত চিপ ব্যবহার করে কম খরচে এমন উন্নত এআই-ডিপসিককে তার দেখা ‘সবচেয়ে যুগান্তকারী উদ্ভাবনগুলোর একটি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট মার্ক আন্দ্রেসেন। ডিপসিকের উত্থান এআই যুগের ‘স্পুটনিক মুহূর্ত’ বলেও অভিহিত করেছেন তিনি।

 

ডিপসিকের অ্যাপ ও ওয়েব সংস্করণ, দুটিই ব্যবহারকারীদের জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত করা হয়েছে। চ্যাটজিপিটির মতো ব্যবহারের কোনো সীমাও থাকছে এতে। ডিপসিকের সর্বশেষ মডেলটি ওপেন সোর্স; অর্থাৎ এতে ব্যবহৃত কোডগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এআই হার্ডওয়্যার কোম্পানি পজিশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ব্যারেট উডসাইড বলেন, ‘ব্যাপারটি সত্যিই অসাধারণ।’ তিনি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে জানান, তিনি ও তার সহকর্মীরা ডিপসিক নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করেই যাচ্ছেন। ওপেনএআই সিইও স্যাম অল্টম্যান দ্রুতই ডিপসিককে চ্যাটজিপিটির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘নতুন প্রতিযোগী পেয়ে সত্যিই উদ্দীপিত লাগছে।’

 

ডিপসিকের আর১-কে ‘চমৎকার মডেল’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, বিশেষ করে তারা যতটা কম খরচে এই কাজ করতে পেরেছে, সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। ওপেনএআইয়ের ভবিষ্যৎ মডেলগুলো আরও দ্রুত বাজারে আনার প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।

 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও দ্রুত এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এএফপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি সোমবার বলেন, ডিপসিককে আমাদের শিল্প খাতের জন্য একটি সতর্ক সংকেত হিসেবে দেখা উচিত। এই প্রতিযোগিতায় জিততে আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে। ডিপসিকের দেখানো পথে মার্কিন কোম্পানিগুলো এখন ‘বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ না করে কম খরচেই একই ফলাফল পেতে পারবে’ বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

 

এদিকে ডিপসিকের উত্থানের প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারেও। এআই খাতের প্রায় সব মার্কিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে দরপতন হয়েছে। প্রযুক্তি কোম্পানি সমৃদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পুঁজিবাজার নাসডাকের সার্বিক দরপতন হয়েছে তিন দশমিক এক শতাংশ। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চিপ-নির্মাতা এনভিডিয়া। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তারা এক দিনে ১৭ শতাংশ শেয়ারমূল্য হারিয়েছে, তাদের বাজারমূল্য কমেছে ৫৯৩ বিলিয়ন (৫৯ হাজার ৩০০ কোটি) মার্কিন ডলার। এটি ওয়াল স্ট্রিটে এক দিনে কোনো কোম্পানির সর্বোচ্চ ক্ষতি।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধের স্পুটনিক ডিপসিক!