ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৫:০০:৫২ পিএম

জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বড় অংশ বেক্সিমকো ও এস আলমের

২০ নভেম্বর, ২০২৪ | ৫:৫৪ পিএম

জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বড় অংশ বেক্সিমকো ও এস আলমের

ছবি: সংগ্রহ

এক সময়ের আর্থিক পাওয়ারহাউস জনতা ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৬১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। অবাধে বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপের মতোন বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোকে ঋণ দেওয়ার ফলে এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি।

 

দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মতো তহবিল না থাকায় ব্যাংকটি এখন দৈনিক প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা অন্য ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এবারই প্রথম মুনাফার পরিবর্তে বড় ধরনের লোকসানে পড়তে যাচ্ছে জনতা ব্যাংক। ডিসেম্বর শেষে লোকসানের পরিমাণ ২,৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখভিত্তিক ব্যাংকটির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা।

 

ব্যাংকটির এই করুণ পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরে গত ১৪ নভেম্বর অর্থসচিব মো. খায়রুজ্জামান মজুমদারকে চিঠি পাঠিয়েছেন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান মুহঃ ফজলুর রহমান। বর্তমান পরিস্থিতিতে জনতা ব্যাংক কিভাবে অগ্রসর হবে, সে বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন চেয়েছেন তিনি।

 

 

তবে জনতা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ রেকর্ড বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে আলোচিত বেক্সিমকো ও এসআলম গ্রুপ নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে ব্যাংকটি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা ২৩ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা, যারমধ্যে ১৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণীকৃত। বাকি প্রায় ৩ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা ওভারডিউ অবস্থায় রয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যা মন্দ ঋণে (খেলাপি) পরিণত হবে।

 

কোনো ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি কোনো একক গ্রাহককে ঋণ না দেওয়ার বিধান রয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইনে। কিন্তু, এই সীমাকে ৪১০ শতাংশ ছাড়িয়ে আশঙ্কাজনক মাত্রায় ঋণগুলো দেওয়া হয়েছে। আইনের এই সুস্পষ্ট লঙ্ঘন সত্ত্বেও সেসময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হিসেবে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

 

 

যৌথভাবে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশই বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপের, যা জনতা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।

 

অর্থসচিবকে দেওয়া জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের চিঠি অনুযায়ী, ঋণ অনাদায়ী হওয়ায় ব্যাংক ভয়াবহ তারল্য সংকটে পড়েছে। ব্যাংকটির এখন নতুন করে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও নেই। এই অবস্থায়, অন্য ব্যাংকের থেকে অর্থ ধার করে চলাও অসম্ভব হয়ে পড়ছে।

 

 

বর্তমানে জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে ৩৯ হাজার ৮৬ কোটি টাকা হয়েছে। মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের ইতিহাসে এমন নাজুক অবস্থা কখনও হয়নি।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২১.২২ শতাংশ।

 

''জনতা ব্যাংকের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে বৃহৎ গ্রাহকের নিকট হতে ঋণ আদায়ের কোন বিকল্প নেই। রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা ছাড়া— জনতা ব্যাংকের সংকট কাটিয়ে ওঠা তথা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় মর্মে পরিলক্ষিত হয়''- বলেছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান।

 

জনতা ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটি গত কয়েক বছরে কিছু শাখার মাধ্যমে অল্পকিছু গ্রাহকের অনুকূলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঋণ বিতরণ করেছে। একক গ্রাহক ঋণসীমাসহ অন্যান্য বিধিবিধান লঙ্ঘন করে বেক্সিমকো, এস আলম গ্রুপ, থার্মেক্স-সহ কিছু গ্রাহকের ঋণের পরিমাণ আগ্রাসীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

এসব কোম্পানির নামে ঋণ বাড়লেও যথাযথভাবে ঋণ আদায় না হওয়ায় তহবিল ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতার কারণে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাতে ধার করে চলতে হচ্ছে। ব্যাংকের মালিক হিসেবে বিষয়টি সরকারের জন্যও উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান।

 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাংকখাত সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "বড় বড় গ্রুপের কাছে পাওনার বিপরীতে কি পরিমাণ জামানত রয়েছে, তার মূল্যায়ন করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে গাইডলাইন চাওয়ার মানে হলো— ব্যাংকটি বাঁচাতে সরকারের কাছ থেকে টাকা চাওয়া, জনতা ব্যাংকের সমস্যা সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া।"

 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, "খেলাপিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি কোম্পানি - এস আলম ও বেক্সিমকো উভয়েই জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছে। এই দুই কোম্পানি যেখানে ছোবল মারে, সেখানে কোন কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না।"

 

''জনতা ব্যাংকের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এভাবে একটি ব্যাংক চলতে পারে না। বেক্সিমকো ও এস আলম– এর সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা আদায় করতে হবে। তা নাহলে জনতা ব্যাংকের মতো শ্বেতহস্তি লালন-পালন করার কোন দরকার নেই। ব্যাংকটিকে হয় অবলোপন করতে হবে, নাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে দেওয়াই শ্রেয়" - বলছিলেন তিনি।

 

তিনি আরও বলেন, তবে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন কর্মহীন না হয়ে পড়েন সেজন্য নীতিনির্ধারক ও বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি সমাধান বের করতে হবে।

জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বড় অংশ বেক্সিমকো ও এস আলমের