ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
৬ অক্টোবর, ২০২৪ | ১০:৪২ এএম
অনলাইন সংস্করণ
জনতা ব্যাংকের ৭৫% ঋণ খেলাপি!
৬ অক্টোবর, ২০২৪ | ১০:৪২ এএম
![জনতা ব্যাংকের ৭৫% ঋণ খেলাপি!](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2024/10/06/20241006104157_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকেরস্থি ৭৫ শতাংশ ঋণই এখন খেলাপির খাতায়। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা। পরিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেকোনো সময় হতে পারে সিআরআর-এসএলআর ঘাটতি। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সর্বশেষ সভায় আর্থিক বিপর্যয়ের এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২০০৯ সালে ব্যাংকটির দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ ছিল ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির ৮২৪তম পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত হয় ১ অক্টোবর। ওই সভায় যে নথি উপস্থাপন করা হয় সেটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকে জমাকৃত আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। সেখান থেকে বিতরণ করা হয়েছে ৯৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকার ঋণ। বিতরণকৃত এ ঋণের অর্ধেকের বেশি তথা ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকাই নিয়েছে মাত্র পাঁচটি গ্রুপ। এর মধ্যে এককভাবে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপই নিয়েছে ২৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এস আলম গ্রুপ ১০ হাজার ১৭১ কোটি, এননটেক্স গ্রুপ ৭ হাজার ৭৭৪ কোটি, ক্রিসেন্ট গ্রুপ ৩ হাজার ৮০৭ কোটি এবং ওরিয়ন গ্রুপ ৩ হাজার ১১ কোটি টাকা নিয়েছে।
জনতা ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরপরই জনতা ব্যাংক পর্ষদে রাজনৈতিক নেতা, দলীয় আদর্শের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আমলা ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবুল বারকাত। সেই থেকে জনতা ব্যাংকে যে লুণ্ঠন শুরু হয়, তা গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
প্রতি তিন মাস অন্তর দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৩০ জুনের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, জুন শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৫২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ওই প্রতিবেদনে জনতা ব্যাংকের কোনো প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি নেই বলেও উল্লেখ করা হয়। তবে সর্বশেষ পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করা নথিতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ২৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ব্যাংকের ১ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা পরিচালন লোকসান হয়েছে। ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত সাড়ে ১২ শতাংশ থাকার কথা থাকলেও জুন পর্যন্ত সেটি মাত্র ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে।
পর্ষদে উপস্থাপিত নথিতে বলা হয়, ৩০ সেপ্টেম্বরভিত্তিক জনতা ব্যাংকের সম্ভাব্য শ্রেণীকৃত ঋণ ৫৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এ ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ খেলাপি। তবে কিছু ঋণ খেলাপিযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন বিধিবিধানের আওতায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ আনুকূল্যে তা অশ্রেণীকৃত দেখানো হয়। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) শ্রেণীকৃত, এসএমএ, পুনঃতফসিলকৃত, পুনর্গঠিত, আদালতে রিটের কারণে নিয়মিত হিসেবে প্রদর্শিত, সুদ মওকুফ সুবিধাপ্রাপ্ত ঋণগুলোকে দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করে।
বিষয়টি উল্লেখ করে পর্ষদে উপস্থাপন করা নথিতে বলা হয়, ‘বর্তমানে ব্যাংকের তহবিল পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় এসএলআর হিসেবে রক্ষিত ট্রেজারি বিল-বন্ডের অতিরিক্ত অংশ লিয়েন রেখে রেপোর মাধ্যমে ধার করে সিআরআর সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসএলআর হিসাবে রক্ষিত ট্রেজারি বিল-বন্ডের অতিরিক্ত অংশ প্রায় শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন প্রয়োজন অনুযায়ী মানি মার্কেট থেকে রেপোর মাধ্যমে ধার করাও যাচ্ছে না। এর ফলে যেকোনো সময় ব্যাংকের সিআরআর ও এসএলআর ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
তারল্য সংকটের কারণ উল্লেখ করে নথিতে বলা হয়, জনতা ব্যাংকের বিশেষ কয়েকটি শাখার মাধ্যমে অল্প কয়েকজন গ্রাহকের কাছে ক্রমাগতভাবে অতিমাত্রায় ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর ফলে ঋণের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ওই শাখাগুলো ঋণ কেন্দ্রীভূতকরণ ঝুঁকিতে পড়েছে। ২০২২ সালে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আর ২০২৩ সালে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ কারণে ২০২২ সালে ঋণের পরিমাণ ৬৯ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২৩ সাল শেষে ৯৮ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এ দুই বছরে জনতা ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি বেড়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। বর্ধিত এ ঋণের সিংহভাগই শীর্ষ কয়েকজন গ্রাহককে দেয়া হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা হলো ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ। ২০০৯ সালের আগে ব্যাংকটিতে এ শিল্পগোষ্ঠীর ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার কোটি টাকারও কম। কিন্তু গত দেড় দশকে নতুন নতুন কোম্পানি খুলে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে তারা। চলতি বছরের জুন শেষে জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকোর ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি ছিল ২৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ হাজার ১৭৫ কোটি টাকাই ছিল খেলাপি।
জনতা ব্যাংকে ২০০৯ সাল-পরবর্তী দেড় দশকে পাঁচ চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবুল বারকাত। ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি টানা পাঁচ বছর সে দায়িত্বে ছিলেন। এরপর ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জনতার চেয়ারম্যান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদ উজ জামান। ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত দোহা টেকের লুনা শামসুদ্দোহা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৪ আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত চেয়ারম্যান ছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ। এরপর ২০২০ সালের ২৯ জুলাই থেকে চলতি বছরের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এসএম মাহফুজুর রহমান। এ পাঁচ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বাধীন পর্ষদে বিভিন্ন সময়ে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা পরিচালক হিসেবে স্থান পান। আবার আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী ও আমলারাও পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
এননটেক্স, ক্রিসেন্ট, বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারিসহ জনতা ব্যাংকের আর্থিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত মনে করা হয় ড. আবুল বারকাতের নেতৃত্বাধীন পর্ষদের সময়কালকে। ওই সময়ে ব্যাংকটিতে সংগঠিত অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল বারকাত বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংকের চেয়ারম্যান কিংবা পরিচালনা পর্ষদ ঋণ বিতরণ করে না। নানা ধাপ পেরিয়ে পর্ষদে ঋণ প্রস্তাব আসে। যথাযথ রীতিনীতি মেনেই আমরা তা অনুমোদন দিয়েছি। আমি দায়িত্ব পালনের সময় ব্যাংকে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে বলে শুনিনি।’
জনতা ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, ব্যাংকের যেকোনো কর্মকাণ্ডে এ পরিচালকদের হস্তক্ষেপ ছিল। এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন বলরাম পোদ্দার ও নাগিবুল ইসলাম দীপু। বলরাম পোদ্দারকে ঋণের কমিশন দিতে গিয়ে এননটেক্সের কর্মকর্তারা ডাকাতির শিকারও হয়েছিলেন।
২০২৩ সালের ৩ মে থেকে গত ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের এমডি ছিলেন মো. আবদুল জব্বার। ১৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য পাঁচ ব্যাংকের এমডির সঙ্গে তাকেও অপসারণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতির কারণ জানতে চাইলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি অল্প সময় জনতা ব্যাংকের এমডি ছিলাম। এ সময়ে ব্যাংকের পরিবর্তন করতে না পারলেও ক্ষতি হতে দিইনি। জনতা ব্যাংক যাতে আর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে চেষ্টাই করেছি।’
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ব্যাংকটির বর্তমান একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি এ ব্যাংকের লোক নই। পদোন্নতি পাওয়ার পর অন্য ব্যাংক থেকে এখানে এসেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, লোকাল অফিস, করপোরেট শাখাসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শাখার বেশির ভাগ কর্মকর্তা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। কেউ অনিয়ম করতে বাধ্য হয়েছেন, কেউ ঘুস-কমিশনের বিনিময়ে জাল-জালিয়াতিতে যুক্ত হয়েছেন। আবার পর্ষদের বর্তমান পরিচালকদের অন্তত তিনজন চরম মাত্রার দুর্নীতিবাজ। অপরাধী কর্মকর্তা ও পরিচালকদের দায়িত্বে রেখে জনতা ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।’
![জনতা ব্যাংকের ৭৫% ঋণ খেলাপি!](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)