ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ২:১৮:৫৬ পিএম

জাইকার টাকা জলে গেল, ট্রাফিক ব্যবস্থা এখনো অচল

৫ অক্টোবর, ২০২৪ | ১০:২৭ এএম

জাইকার টাকা জলে গেল, ট্রাফিক ব্যবস্থা এখনো অচল

ছবি: সংগ্রহ



ঢাকা মহানগরে যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ হিমশিম খায়। এমন বাস্তবতায় ২০১৫ সালে ডিটিসিএ ট্রাফিক শৃঙ্খলায় জাইকার অর্থায়নে প্রকল্প হাতে নেয়। তখন বলা হয়েছিল, ঢাকা মহানগরীর চারটি মোড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিগন্যাল স্থাপনের মাধ্যমে যানবাহনে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। যদিও ট্রাফিকের চার বিভাগের হিসাবে রাজধানীতে ব্যস্ত মোড়ের সংখ্যা ৬২টি। মাত্র চারটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিগন্যাল স্থাপন করে যানজট নিরসন কতটা সম্ভব- তা নিয়ে প্রকল্পের শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিল ডিএমপি।

 

পুরো টাকা জলে যাচ্ছে কিনা- এ প্রশ্নে ডিটিসিএ বলেছিল, চারটি আইটিএস স্থাপন করা হচ্ছে সমীক্ষার অংশ হিসেবে। সফল হলে সব মোড়ে একই রকম সিগন্যাল বসবে। এখন সফলতার মুখ দেখা দূরের কথা, যন্ত্র নিয়েই বিপাকে পড়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আওতাধীন সংস্থা ডিটিসিএ। চালুর আগেই চুরি এবং অকেজো হয়ে পড়ায় তারা এসব সরঞ্জাম কোথায় ও কার কাছে কখন হস্তান্তর করবে সেই ভাবনায় ঘর্মাক্ত।

 

গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, এসব সিগন্যাল আর চালু করার সুযোগ নেই। নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থায় এগুলো যুক্ত করার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কার্যকর হয়নি।

 

জানা গেছে, ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টটি অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর। এ সংক্রান্ত এক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ডিএমপিতে হস্তান্তরের কথা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ডিএমপি এসব যন্ত্রপাতি গ্রহণে রাজি হয়নি। ডিএমপির সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে সার্ভার কম্পিউটার স্থাপনের ব্যাপারে বলা হলে জানানো হয়, সরঞ্জামাদি স্থাপনের সময় ডিএমপির দাপ্তরিক সম্মতি গ্রহণ করা হয়নি। তাই রক্ষিত সরঞ্জাম ডিএমপির পক্ষে গ্রহণ সম্ভব নয়। আবার স্থাপিত আইটিএস সরঞ্জামাদির ইনভেন্টরি লিস্ট করতে চাইলে পরিদর্শনকালে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি প্রতিনিধিরা অংশ নেননি। 

 

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ইতোমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারের মাধ্যমে মহাখালী ইন্টারসেকশনে আলট্রাসনিক ভেহিক্যাল ডিটেক্টরসহ সিগন্যাল পোল কর্তন হয়েছে। গুলশান-১ ইন্টারসেকশনে পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুর্ঘটনায়। পল্টন ইন্টারসেকশনে যানবাহনের আঘাতে পথচারী সিগন্যাল পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া বৈদ্যুতিক সংযোগের অভাবে ইন্টারসেকশনগুলোয় স্থাপনকৃত ব্যাকআপ ব্যাটারিগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। এ সরঞ্জামাদি রক্ষণাবেক্ষণের কোনো স্থান ও অর্থ বরাদ্দ নেই। এ জন্য জনবলও নেই ডিটিসিএর।

 

প্রকল্পটি সমাপ্তির পর সরঞ্জামাদি সিটি করপোরেশন ও ডিএমপির কাছে হস্তান্তরের বিষয় উল্লেখ আছে টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রজেক্ট প্রপোজালে (টিএপিপি)। এতে বলা হয়, ইন্টারসেকশনগুলো যেহেতু সিটি করপোরেশন এলাকার অধীনে আর সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে স্থাপিত সরঞ্জামাদি ডিএমপির আওতাধীন, তাই এসব স্থানে স্থাপিত সরঞ্জামাদি সংরক্ষণের জন্য তাদের কাছে হস্তান্তরই যৌক্তিক বলে মনে করছে ডিটিসিএ। যদিও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা ডিটিসিএকে জানিয়েছেন, স্থাপনের সময় এসব যন্ত্রপাতি সচল নাকি অচল ছিল তা জানা নেই। তাই এগুলোর দায়িত্ব নিতে সিটি করপোরেশনের আগ্রহ নেই।

 

জানা গেছে, ২০১৫ সালে ৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প নেওয়া হয়। পরে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ কোটি ৮ লাখ টাকা। এতে ১৮ কোটি টাকা ৮৬ লাখ টাকা ঋণ দেয় জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালে গুলশান-১, মহাখালী, পল্টন ও ফুলবাড়িয়া (গুলিস্তান) মোড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ট্রাফিক সিগন্যাল বা আইটিএসের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়। এর জন্য বিশেষায়িত তারের সংযোগ, পোল ও বাতি স্থাপন করা হয়েছে। এরপর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ডিশের ও ইন্টারনেটের তারের জঞ্জাল অপসারণ অভিযানে মহাখালী ও গুলশানের আইটিএসের সংযোগ তার কাটা পড়ে। পল্টনে তার কাটা পড়েছে মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজে।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যমান ট্রাফিক সিগন্যালে নির্ধারিত সময়ে লাল-সবুজ-হলুদ বাতি জ্বলে। কিন্তু আইটিএস সিগন্যাল এলাকার ২৫০ মিটারের মধ্যে থাকা গাড়ির সংখ্যা উচ্চ রেজল্যুশনে তোলা ছবি সংযুক্ত কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করে গুনতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে গাড়ির সংখ্যা ও ঘনত্বের ভিত্তিতে লাল-সবুজ-হলুদ বাতি জ্বালায়, রাস্তা বন্ধ করে। মোড়ের এক পাশের রাস্তার যানবাহন পার হওয়ার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপর পাশের রাস্তার যানবাহনকে চলাচলের সংকেত দেবে। উন্নত দেশগুলোতে এ পদ্ধতিতেই শহর এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

 

ডিটিসিএর কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রকল্পের গোডাউনে কড়া পাহারার মধ্যেই সার্ভার কম্পিউটার চুরি যাওয়ার ঘটনায় মামলা করেছিল ডিটিসিএ। সংস্থাটির তদন্ত কমিটি চুরির জন্য দায়ী করেছিল ‘সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি’কে। থানা পুলিশ ও গোয়েন্দারাও চুরির রহস্য কিনারা করতে পারেনি। এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, কম্পিউারের দাম ৯ লাখ টাকা। সফটওয়্যার ‘কাস্টমাইজ’ ও ‘কনফিগার’ করে ইনস্টল করার খরচ ধরা আছে দুই কোটি ৬২ লাখ টাকা।

 

প্রসঙ্গত, রাজধানীর সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল থাকলেও তা কার্যকর নয়। ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় চলে যানবাহন। ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে ৭০টি মোড়ে সিগন্যাল বাতি স্থাপন করা হয়েছিল। তা টেকেনি। ২০১৮ সাল পর্যন্ত ফের বাতি বসানো হলেও ব্যবহার নেই। ২০১৫ সালে বনানী থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত ১১ পয়েন্টে সিগন্যাল বাতির মাধ্যমে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা তীব্র যানজটের কারণে ভ-ুল হয়ে যায় মাত্র ছয় ঘণ্টার মাথায়।

জাইকার টাকা জলে গেল, ট্রাফিক ব্যবস্থা এখনো অচল