ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৮:৫৬:০২ পিএম

জ্বালানি তেল আমদানির শর্ত শিথিল করার পরিকল্পনা সরকারের

২৪ নভেম্বর, ২০২৪ | ১২:০ পিএম

জ্বালানি তেল আমদানির শর্ত শিথিল করার পরিকল্পনা সরকারের

ছবি: সংগ্রহ

বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল আমদানির শর্ত শিথিল করে ছয় মাসে ৩৬০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের আশা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। জ্বালানি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসিকে সরবরাহ করার ক্ষেত্রে শর্ত ছিল যে সরবরাহকারীকে রিফাইনারির মালিক হতে হবে। এই শর্ত শিথিল করে ছয় মাসে (জানুয়ারি থেকে জুন) ৩৬০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা যাবে বলে আশা করছে সরকার।

 

ঢাকার ওয়েস্টিন হোটেলে অনুষ্ঠিত 'শিল্প খাতে জ্বালানি সংকট নিরসনের উপায়' শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।বিপিসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'জুলাই-ডিসেম্বর সময়কালে ডিজেল আমদানির জন্য প্রতি ব্যারেলে প্রিমিয়াম ছিল ৮.৭৫ শতাংশ। এবার দরপত্রে ১৪টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে, যার মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন ৫.১৮ শতাংশ ও ৫.৪৪ শতাংশ প্রিমিয়াম প্রস্তাব করেছে। এজন্য এ সাশ্রয় করা যাবে।'

 

এদিকে চলমান গ্যাস সংকট নিরসনে এবং শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকার গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার। তিনি জানান, সমুদ্র উপকূলে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আগামী ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। এছাড়া পাহাড়ি অঞ্চলসহ স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আগামী বছরের মার্চ মাসে দরপত্র আহ্বান করার পরিকল্পনা রয়েছে।

 

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার এই উদ্যোগ নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, দেশের জ্বালানি খাতে শেভরনের মতো আন্তর্জাতিক জ্বালানি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

 

স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে যে-কেউ স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে পারবে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান।

 

এই ঘোষণা এমন সময়ে এল, যখন উদ্যোক্তা ও শিল্পপতিরা চলমান গ্যাস সংকট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, গ্যাসের অভাবে কারখানাগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালানো সম্ভব হচ্ছে না, ফলে অনেক কাখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

 

 

তিনি বলেন, ভোলায় ৭০ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া গেলেও পাইপলাইন না থাকায় ওই গ্যাস ঢাকায় বা শিল্প এলাকায় আনা যাচ্ছে না।

 

জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, 'বিগত সরকারের সময় ২৩টি কোম্পানি এলএনজি সরবরাহ করত। এটা আমরা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছি। গ্যাসকূপ খননও উন্মুক্ত করে দরপত্র দেওয়া হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে অফশোরের বিডিং হবে। '

 

ফাওজুল কবির বলেন, সরকার আগামী সপ্তাহে ৩০-৪০টি নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প স্থাপনের জন্য দরপত্র আহ্বান করবে।

 

তিনি আরও জানান, বর্তমানে সরকার বিদ্যুৎ খাতে বছরে ৩৬ হাজার কোটি টাকা, জ্বালানিতে ২০ হাজার কোটি টাকা ও এলএনজি আমদানিতে বছরে ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে।

 

বর্তমানে সরকার বিদ্যুৎ খাতে বছরে ৩৬,০০০ কোটি টাকা, জ্বালানি তেল খাতে ২,০০০ কোটি টাকা এবং এলএনজি আমদানি খাতে ৬,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে।

 

 

এর জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আগের সরকারের সময় বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে বলা হতো। এখন শিল্প খাতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ছে। আগামী বছরে ধীরে ধীরে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।

 

তিনি বলেন, ২০২৫ সালে ১১৫ কার্গো এলএনজি আমদানি করতে হবে, যার মধ্যে ৫৬ কার্গো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় পাওয়া যাবে। বাকিটা স্পট মার্কেট থেকে কিনতে হবে।

 

'কূপ খননের ডিপিপিগুলো ২-৩ মাসের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে ২০২৫-এর ডিসেম্বরের মধ্যে ৫০টি কূপ খনন করা সম্ভব হবে,' বলেন তিনি।

 

ব্যবসায়ীরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস শিল্পে সরবরাহ করার দাবি জানালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ কমানো হলে কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে।

 

এর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এতে হয় সরকারের ভর্তুকি বাড়বে, নয়তো লোডশেডিং বাড়াতে হবে। তাই আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

 

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক এজাজ আহমেদ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, ২০২০ সাল থেকে তিন বছরে বাংলাদেশে গড়ে গ্যাসের সিস্টেম লস ৯.৮২ শতাংশ, যার বার্ষিক মূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। একে সিস্টেম লস না বলে 'চুরি' হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

 

তবে সিস্টেম লসের এই তথ্য মানতে আপত্তি জানান পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, পেট্রোবাংলার গড় সিস্টেম লস ৫-৬ শতাংশ। তবে তিতাস ও বাখরাবাদের সিস্টেম লস অনেক বেশি।

 

পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান আরও বলেন, সম্প্রতি কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে ২০০ কারখানায় অবৈধ লাইন বন্ধ করা হয়েছে। এখন নারায়ণগঞ্জে অভিযান চলবে। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা চান তিনি।

 

এজাজ আহমেদ বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন কমেছে ৩০-৩৫ শতাংশ, স্টিল ইন্ডাস্ট্রির উৎপাদন কমেছে ২৫-৩০ শতাংশ, সিরামিক উৎপাদন কমেছে ৫০ শতাংশের বেশি এবং প্রায় ৪০ শতাংশ এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ) বন্ধ হয়ে গেছে।

 

তিনি আরও বলেন, শিল্প খাতে ১,০৪০ এমএমসিএফ গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে ৫০০ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সাভার, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বাংলাদেশের শিল্প হাব হলেও সেখানে গ্যাসের প্রবাহ নেই।

 

 

গ্যাস সংকটের কারণে এই মুহূর্তে শিল্পে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে তা সংকুচিত হচ্ছে উল্লেখ করে অ্যাপেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম মঞ্জুর বলেন, 'আমাদের সাভারের কারখানায় দুটি রোলস-রয়েস জেনারেটর পলিথিন দিয়ে তিন বছর ধরে ঢেকে রাখছি, কারণ গ্যাস পাওয়া যায় না।'

 

 

এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টুও একই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট দূর না হলে দেশে নতুন কোনো বিনিয়োগ হবে না, কর্মসংস্থানও হবে না। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু মুদ্রানীতি ব্যবহার করছে।'

 

এফবিসিসিআই-এর আরেক সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, 'আওয়ামী লীগের সময়ে ট্রান্সপারেন্সি বলে কিছুই ছিল না। তাই আমাদের এখন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গাজীপুরের কারখানা গ্যাস পায় না, অথচ একই পাইপলাইন দিয়ে ময়মনসিংহে থাকা ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাস পাচ্ছে। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে গাজীপুরের কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করা উচিত।'

 

এফবিসিসিআই সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, 'টেক্সটাইল কারখানায় ৩০-৩৫ শতাংশ লোডশেডিং হচ্ছে। ডিজেল কিনে জেনারেটর চালিয়ে কারখানা পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। গ্যাস সংকটের কারণে নরসিংদীর এক টেক্সটাইল মিল মালিক তার কারখানার একাংশ বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি একদিন আমার সঙ্গে নামাজ পড়ার সময় সেজদায় গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।'

 

'যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, সেসব কারখানার শ্রমিকরা অন্য কারখানার গেটে এসে চাকরির জন্য ভাঙচুর করছেন। আমি চাকরি দেব কীভাবে, আমার কারখানাও তো বন্ধ হয়ে যাবে। বর্তমানে গ্যাস বিদ্যুতের যে পরিস্থিতি, তাতে কারখানা চালাতে পারলেও আমরা টিকতে পারব না।

 

সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, '২০১৮-২১ সময়ে আমরা গ্যাসের অনুমতি পেয়ে কারখানা স্থাপন করেছি। কিন্তু সরকার থেকে এখনও আমাদের গ্যাস দেওয়া হচ্ছে না। এতে কারখানাও চালু করা যাচ্ছে না।'

 

 

তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২৮৬.৫ শতাংশ, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৩৩.৫০ শতাংশ, ডিজেলের দাম বেড়েছে ৬৮ শতাংশ ও পরিবহন খরচ বেড়েছে ৫০ শতাংশ। এই সময়ে ফ্রেইট খরচ বেড়েছে ৩০-৪০ শতাংশ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০০ো পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, ৩০০ কারখানা এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

 

পারভেজ বলেন, 'যেখানে শিল্পগুলো ৮৫-৯০ শতাংশ উৎপাদন না করলে ব্রেক ইভেনে আসা যায় না, সেখানে ৬০-৭৫ শতাংশ প্রোডকশন দিয়ে ব্যাংক ডিফল্টার হওয়া ছাড়া কোনো পথই নেই।'

 

তিনি আরও বলেন, 'সব খাতে সংস্কার করার ক্ষেত্রে সময় নিয়ে করা যায়, কিন্তু শিল্পের ক্ষেত্রে সময় নেওয়া আত্মঘাতী। উই হ্যাভ নো টাইম টু স্পেন্ড।'

জ্বালানি তেল আমদানির শর্ত শিথিল করার পরিকল্পনা সরকারের