ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৫:১৫:৪১ পিএম

ডেটা সেন্টারে দেড় হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ

১০ অক্টোবর, ২০২৪ | ১০:৩৭ এএম

ডেটা সেন্টারে দেড় হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ

ছবি: সংগ্রহ

দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয় ডেটা সেন্টার। আওয়ামী লীগ সরকার এটিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের হৃদয় বলে অভিহিত করত। সিন্ডিকেট, কারিগরি অদক্ষতা ও কমিশন বাণিজ্যের কারণে ব্যয়বহুল এ প্রকল্প অনেকটাই ব্যর্থ। নিজস্ব ক্লাউড সেবা কাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি ডেটা সেন্টার কোম্পানি (বিডিসিসিএল)।

 

আরও অর্থ খরচ করে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ক্লাউড সেবা নিয়েছে। নিজের ডেটা সেন্টারের বদলে বিদেশি ক্লাউড সেবায় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথি রাখা হয়েছে। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হওয়ার পাশাপাশি হুমকির মুখে সরকারি ও ব্যক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের নিরাপত্তা।

 

 

বিডিসিসিএল নিজেদের স্বার্থ উপেক্ষা করে বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি করেছে। এসব অপকর্মে জড়িত সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সিন্ডিকেট। তাদের দুর্নীতির কারণে সব মিলিয়ে রাষ্ট্রের গচ্চা গেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।

 

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় তৈরি করা হয় ফোর টায়ার জাতীয় ডেটা সেন্টার। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর শুরু হয়ে নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৯ সালের জুনে। প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতায় ব্যয় বাড়ে ১০০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে এটি পরিচালনায় বিডিসিসিএল গঠন করা হয়। কাজ করে চীনের কোম্পানি জেডটিই।

 

 

বিডিসিসিএল ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, ক্লাউড সেবার জন্য ১৫২টি র‍্যাক সমৃদ্ধ মডুলার ডেটা সেন্টারে ৭৪৪টি ফিজিক্যাল সার্ভারের সমন্বয়ে ২ পেটাবাইট ক্লাউড স্টোরেজ রয়েছে, যা ২০০ পেটাবাইট পর্যন্ত সম্প্রসারণযোগ্য। এই ডেটা সেন্টার থেকে ক্লাউড কম্পিউটিং, ক্লাউড ডেস্কটপ, ক্লাউড স্টোরেজ, ডেটা স্টোরেজ, ব্যাকআপ, ডেটা সিকিউরিটি ও কো-লোকেশন সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত ২ হাজার ক্লাউড ডেস্কটপ সেবা পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন জটিলতায় জেডটিইর সঙ্গে ফাইনাল অ্যাকসেপ্টেন্স সার্টিফিকেট-সংক্রান্ত কার্যক্রম সঠিকভাবে নিষ্পত্তি হয়নি।

 

 

সূত্র জানিয়েছে, ২০১৬ সালে প্রথম প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের পরিচালক তারেক এম বরকতউল্লাহ। পিডি হিসেবে প্রকল্পে থাকা অবস্থায় এবং পরে কোম্পানি হওয়ার পর কম্পিউটার কাউন্সিলের পরিচালক (ডেটা সেন্টার) হিসেবে বিডিসিসিএলের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন পলকের ঘনিষ্ঠ এম বরকতউল্লাহ। বিডিসিসিএল বোর্ডের পরিচালক রকিব আহমেদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস সাইফুজ্জামান শিখরের বন্ধু। মন্ত্রণালয়ের বৈঠকগুলোতে পলক তাঁকে বড় ভাই হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। বোর্ড পরিচালক হওয়ার আগে ঠিকাদার হিসেবে প্রকল্পের বিভিন্ন কাজ করেন রকিব।

 

২০২১ সালের ১৬ অক্টোবর রকিব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক হন। সিন্ডিকেট শক্তিশালী করতে ডেটা সেন্টারে নিজের ঘনিষ্ঠ লোকজনকে নিয়োগ দেন পলক। এ জন্য নিয়মকানুন শিথিল করা হয়। সাবেক প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সহকারী সচিব (এপিএস) রণজিত কুমার নিয়োগ পান ব্যবস্থাপক (ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং) পদে। চাকরিতে যোগদানের পরও ২০২২ সালের অক্টোবরে গঠিত নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিতে সহসভাপতি ছিলেন তিনি। রণজিতের মতো বিশেষ সুবিধায় ব্যবস্থাপক (লজিস্টিকস) পদে চাকরি পেয়েছেন পলকের সাবেক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ইকরামুল হক। একজন বোর্ড পরিচালক জানিয়েছেন, কোম্পানিতে জনবল নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশন করানো হতো না। অন্য দেশের নাগরিক, অন্য কোম্পানিতে চাকরিচ্যুত হওয়াসহ নানা অভিযোগ আছে এমন ব্যক্তিরাও নিয়োগ পেয়েছেন।

 

 

দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ডেটা সেন্টারের ক্লাউড ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে সিন্ডিকেট নতুন ক্লাউড সিস্টেম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। রকিব সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্র এবং পলকের চাপে ওরাকলকে ১৮ মিলিয়ন ডলারের (২০৭ কোটি টাকা) কাজ সরাসরি টেন্ডারে দেওয়া হয়েছে।

 

 

 

ওরাকল ২০২০ সালে জাতীয় ডেটা সেন্টারকে (এনডিসি) একটি ক্লাউড সিস্টেম গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়। পলকের ইশারায় তারেক এম বরকতউল্লাহর মাধ্যমে এ প্রস্তাব বিডিসিসিএলে দেওয়া হয়। তবে সে সময় সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটি এই ক্লাউড সেবার বিরোধিতা করে বিডিসিসিএলের ক্লাউড অবকাঠামো উন্নয়নের কথা বলে। পলকের চাপে বিডিসিসিএল ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর ওরাকলের সঙ্গে তিন বছরের জন্য ১৮ মিলিয়ন ডলারে ডেডিকেটেড রিজিওনাল ক্লাউড স্থাপনে চুক্তি করে। চুক্তি সই করার প্রায় আড়াই বছর পর গত মে মাসে ক্লাউড সেবা চালু করে ওরাকল। দেশে ক্লাউড সেবা গড়ে তোলার সময় ওরাকলেরই সিঙ্গাপুর ক্লাউডে দেশের তথ্য বাতায়নসহ গুরুত্বপূর্ণ সব নথি সংরক্ষণ করা শুরু করে আইসিটি মন্ত্রণালয়। এ জন্য ওরাকলকে বছরে অতিরিক্ত ৪ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়া হয়, যদিও পলকের নেতৃত্বাধীন আইসিটি মন্ত্রণালয় এ সময় দেশের তথ্য দেশেই রাখাতে হবে– এমন বিধান রেখে উপাত্ত সুরক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ আইনের বিরোধিতা করে আসছে।

 

 

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বিডিসিসিএল জেননেক্সট টেকনোলজিস নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে। জেননেক্সট বিডিসিসিএল অবকাঠামো ব্যবহার করে মেঘনা ক্লাউড নামে একটি ক্লাউড সেন্টার স্থাপন করেছে। এতে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ডেটা নথি রাখা হয়েছে। জেননেক্সট টেকনোলজিসের চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের একজন প্রভাবশালী কূটনীতিকের স্বামী। এই চুক্তি দেখিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী বিডিসিসিএল আয়ের ৩০ শতাংশ পাবে। জেননেক্সট নেবে ৭০ শতাংশ। এটিকে সংশ্লিষ্টরা কালো চুক্তি বলে অভিহিত করছেন।

 

 

 

জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, প্রযুক্তি খাতের অনিয়ম চিহ্নিত করতে তারা কমিটি করেছেন। তাদের রিপোর্ট পেলেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডেটা সেন্টারে দেড় হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ