ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১০:১০ এএম
অনলাইন সংস্করণ
ধুঁকছে শিল্প-কারখানা
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১০:১০ এএম
![ধুঁকছে শিল্প-কারখানা](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2025/02/11/20250211101044_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
দিন দিন একের পর এক থেমে যাচ্ছে শিল্প-কারখানার চাকা। বহুমুখী সংকট একেবারে ঘিরে ধরেছে দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের মেরুদণ্ড শিল্প খাতকে। বড় সংকট এখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থাহীনতা বাড়ছে। দফায় দফায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি ও ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোও ব্যবসায়ীদের ওপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। শিল্পে গ্যাস সংকট এখনও প্রকট। গরম না আসতেই শুরু হয়ে গেছে লোডশেডিং। এসব কারণে শিল্পের উৎপাদন কমেছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। আর সংকটে পড়ে গত ছয় মাসে শুধু পোশাক কারখানাই বন্ধ হয়েছে প্রায় ৩০০টির মতো। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা যে কত বন্ধ হয়েছে, তার সঠিক তথ্য জানেন না কেউ।
একের পর এক শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ায় গত ছয় মাসে ৫ থেকে ৬ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন শিল্প মালিকরা। বেকার হয়ে পড়ায় শ্রমিকদের আয়-রোজগারও বন্ধ হয়ে গেছে। আর কর্মহীন হয়ে পড়ায় আহার জোটাতে অনেক শ্রমিক ছিনতাই-রাহাজানিতে জড়িয়ে পড়ছে। তার প্রমাণ মিলবে-সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেশে ছিনতাই-ডাকাতি যে হারে বেড়েছে সেদিকে তাকালে।
শিল্প মালিকরা বলছেন, বহুমুখী সংকটে পড়ে শিল্প-কারখানা চালু রাখাসহ ব্যবসা করা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থাহীনতা এখন চরম পর্যায়ে। এভাবে চলতে থাকলে থেমে যাবে শিল্পের চাকা। তখন ভঙ্গুর অর্থনীতি একেবারে মুখ থুবড়ে পড়বে।
শিল্প-কারখানার সংকটের বিষয়ে বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি ও সংগঠনটির আসন্ন নির্বাচনে ফোরাম প্যানেল লিডার মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, শিল্প-কারখানায় উৎপাদন পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নত হয়নি। গত আগস্টের পর থেকে টানা তিন মাস শিল্পে যে অস্থিরতা চলেছে, সেটি হয়তো এখন নেই; কিন্তু পোশাক শিল্পসহ পুরো শিল্প খাতের অবস্থা এখনও খুবই নাজুক। তিনি বলেন, ‘সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। দেশের অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষের মতো আমরা ব্যবসায়ীরাও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন এবং শুধু আমরা না, আমাদের যারা বিদেশি ক্রেতা রয়েছেন তারাও উদ্বেগ জানাচ্ছেন। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের দাবি, যেকোনো মূল্যে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করুন।’
শিল্পের চলমান অন্যান্য সংকটের বিষয়ে মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে দফায় দফায় ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়াচ্ছে, তাতে শিল্প মালিকদের কারখানা চালু রাখাসহ ব্যবসা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতেই দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ থমকে আছে। এর মধ্যে যদি ব্যাংকের সুদ বেড়েই চলে তা হলে পুরোনো ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পরিচালনা করা যেমন কঠিন হচ্ছে, তেমনি যারা নতুন করে বিনিয়োগ করবেন বলে ভাবছেন তারাও হাত গুটিয়ে নেবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপির সময়সীমায় যে ছাড় দিয়েছে, তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী মার্চে। দেশের এ পরিস্থিতির মধ্যে অন্তত খেলাপির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়াতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। যদি সেটি না করে তা হলে অনেক ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যাবেন।’
সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ে শিল্প-কারখানা রয়েছে ১ হাজার ৮৬৩টি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানা ৭৪৫টি। শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানার মধ্যে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে ১৭টি। এতে ১০ হাজার ৮১ জন চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৫ হাজার ৭৫, পুরুষ শ্রমিক ৪ হাজার ৪১ জন এবং কর্মচারী-কর্মকর্তা রয়েছেন ৯৬৫ জন। গাজীপুর নগরের জরুন এলাকার কেয়া গ্রুপ প্রায় ২০ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছে। গত ২ জানুয়ারি গ্রুপ কর্তৃপক্ষ এক নোটিসে জানায়, আগামী ১ মে থেকে চারটি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হবে। এরপর তারা আরও দুটি কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয়।
গার্মেন্টস ছাড়াও সিমেন্ট, ইস্পাত ও কাগজ শিল্পের অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাজার অস্থিতিশীলতা, সুদহার বৃদ্ধি, ঋণপত্র খোলার (এলসি) অভাবে কাঁচামালের অপর্যাপ্ততা, শ্রমিক অসন্তোষ ও কারখানার উৎপাদন কার্যক্রমের অপ্রতুলতার কারণে এসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার নতুন করে বিনিয়োগের সাহস পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা।
এদিকে শিল্প এলাকার কারখানাগুলো তীব্র গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে। ডিজেল দিয়ে চলছে কারখানাগুলো। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছেন না। এশিয়া অঞ্চলে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের চেয়ে ব্যবসায়িক পরিবেশ বিচারে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প-কারখানার সার্বিক উৎপাদন ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। ডাইং ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো শিপমেন্ট (রফতানি প্রক্রিয়া) করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিভিন্ন বিদেশি বায়ার ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে নিটওয়্যার এক্সপোর্ট কার্যক্রমে ধস নামার আশঙ্কা করছেন তারা।
নারায়ণগঞ্জের গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস অফিসের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের পাইপলাইনে গ্যাসের চাহিদা ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সংকট আছে। নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের শিল্প-কারখানা ও বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাহিদা ১ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ন্যাচারাল বা পাইপলাইনে গ্যাসের চাহিদা ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর এলএনজির চাহিদা ৬৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু চাহিদার তুলনায় ন্যাচারাল গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এলএনজি মোটেও পাওয়া যাচ্ছে না।
আরেক শীর্ষ ব্যবসায়ী ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকিন আহমেদ দেশের বর্তমান ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের উৎপাদন পরিস্থিতি বিষয়ে বলেন, ‘দিন দিন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে হারে অবনতি হচ্ছে তাতে ব্যবসায়ীদের আস্থাহীনতা বাড়ছে। বলা যায় ব্যবসায়ীদের আস্থাহীনতা এখন চরমে। এভাবে চলতে থাকলে তো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাই কঠিন হবে।’
অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিগত ছয় মাস ধরে দেশের শিল্প খাতে যে দুর্দশা চলছে তা রীতিমতো চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একসঙ্গে অনেক সংকট শিল্পকে ঘিরে ধরায় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিল্প-কারখানা সচল রাখা না গেলে অর্থনীতি ধসে পড়বে।’
![ধুঁকছে শিল্প-কারখানা](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)