ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৩:৩০:৪৪ এএম

পরিবেশবান্ধব কনটেইনার জাহাজ নির্মাণ বাড়লেও রয়ে গেছে জ্বালানির অনিশ্চয়তা

২২ নভেম্বর, ২০২৪ | ৭:৩০ পিএম

পরিবেশবান্ধব কনটেইনার জাহাজ নির্মাণ বাড়লেও রয়ে গেছে জ্বালানির অনিশ্চয়তা

ছবি: সংগ্রহ

কার্বন নিঃসরণের ক্ষতিকর প্রভাব এড়ানোর লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে মায়েরস্ক, সিএমএ সিজিএম বা কসকোর মতো শিপিং জায়ান্ট। এ সিদ্ধান্তের পেছনে গ্রাহক ও নিয়ন্ত্রক চাহিদা প্রাধান্য বিস্তার করছে। গ্রিনহাউজ গ্যাস (জিএইচজি) কম নিঃসরণ করবে, এমন কয়েকশ জাহাজের ক্রয়াদেশ দিয়েছে এসব কনটেইনার জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানি। কিন্তু ক্রয়াদেশ বিশ্লেষণ করে এ শিল্পের অনিশ্চয়তা উঠে এসেছে। ভবিষ্যতে কোন সবুজ জ্বালানি প্রাধান্য পাবে বা সাশ্রয়ী ও ব্যাপকভাবে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। এ অনিশ্চয়তা এড়াতে কোম্পানিগুলো ডুয়াল-ফুয়েল বা দ্বৈত জ্বালানি ইঞ্জিন বেছে নিচ্ছে। 


জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে শিপিং ডিকার্বোনাইজিং গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিশ্বব্যাপী নিঃসৃত গ্রিনহাউজ গ্যাসের প্রায় ৩ শতাংশ নিঃসরণ করে এ খাত। তবে নতুন জাহাজ ও জ্বালানি উৎপাদনে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হওয়ায় এ খাতের পরিবেশবান্ধব রূপান্তর কঠিন হয়ে উঠছে।


জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের লক্ষ্য অনুসারে, ২০৫০ সালের মধ্যে শিপিং খাতে কার্বন নিঃসরণ শূন্য হবে। সেখানে আবার কোম্পানিগুলো কীভাবে এ লক্ষ্যে পৌঁছবে তার দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে। নরওয়েভিত্তিক জাহাজ সার্টিফায়ার ডিএনভির মেরিটাইম বিভাগের সিইও নুট অরবেক-নিলসেন বলেন, ‘এখনো কোনো একক জ্বালানি বা প্রযুক্তির প্রাধান্য নেই।’


এ অনিশ্চয়তা মোকাবেলায় ওয়ালমার্ট, অ্যামাজন, আইকিয়া ও নাইকির মতো কোম্পানির জন্য পণ্য সরবরাহকারী বড় কার্গো জাহাজ অপারেটররা একক ইঞ্জিনের বদলে হাইব্রিড ইঞ্জিনের দিকে ঝুঁকছেন। এগুলো সবুজ জ্বালানি চলবে, আবার এ ধরনের জ্বালানির সহজলভ্য না হলে বা ব্যয়বহুল হলে পেট্রোলিয়ামে চলবে।

 

ডিএনভির তথ্যানুসারে, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কনটেইনার শিপিং কোম্পানি থেকে ক্রয়াদেশ পাওয়া ৫২২টি দ্বৈত জ্বালানির জাহাজের সরবরাহ বাকি ছিল।৷ এর মধ্যে ৩০৩টি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (এলএনজি) চালানোর উপযোগী, ২১৬টি মিথানল, দুটি হাইড্রোজেন ও একটি অ্যামোনিয়া পুড়িয়ে চলবে।

 

মেরিটাইম সফটওয়্যার ও পরিষেবাদাতা ভেসন নটিক্যালের সিনিয়র অ্যানালিস্ট রেবেকা গ্যালানোপোলোস জানান, চলতি বছরে ক্রয়াদেশ দেয়া ৬৫ শতাংশ কনটেইনার জাহাজ ছিল দ্বৈত জ্বালানি ইঞ্জিনের। ২০১৮ সালে এর হিস্যা ছিল ৪ শতাংশ। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, শিপিং খাতের শীর্ষ কোম্পানিগুলো ভবিষ্যৎ জ্বালানি চাহিদা ও এর সরবরাহ নিয়ে কী ভাবছেন।

 

সামুদ্রিক জাহাজগুলো সাধারণত পেট্রল, ডিজেল ও জেট ফুয়েলের সস্তা অবশিষ্টাংশ ব্যবহার করে। প্রতি বছর এ খাতে পোড়ানো হয় প্রায় ২৫০ কোটি ব্যারেল ভারী জ্বালানি। অন্যদিকে জাতিসংঘের কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অনুসারে, পুরো শিপিং শিল্পকে ডিকার্বোনাইজ করতে প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি ডলার খরচ হতে পারে এবং এ শিল্পের নতুন জ্বালানির দাম দ্বিগুণ হতে পারে।

 

কনটেইনার শিপিং ইন্ডাস্ট্রির মোট জাহাজ ৬ হাজার ৫৪৩টি। এটি বৈশ্বিক নৌবহরের ছোট অংশ হলেও জলবায়ুর ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। কারণ এগুলো দ্রুতগতিতে চলে এবং তুলনামূলক বেশি জ্বালানি ব্যবহার করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কনটেইনার শিপিং কোম্পানিগুলো পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের অগ্রভাগে রয়েছে। ডিএনভির তথ্যানুযায়ী, তারা অন্য কার্গো খাতের তুলনায় বিকল্প জ্বালানিচালিত জাহাজের দ্বিগুণ ক্রয়াদেশ দিয়েছে।

 

প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর জাহাজগুলো ব্যবহৃত রান্নার তেলসহ বিভিন্ন পণ্য থেকে তৈরি বায়োডিজেলেও চলতে পারে। কিন্তু এ জ্বালানির সরবরাহ সমুদ্র পরিবহন শিল্পের প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট নয়।

 

শিপিং জায়ান্ট সিএমএ সিজিএম বায়োডিজেল ব্যবহারের পরিকল্পনায় এগিয়ে রয়েছে। কোম্পানিটি এ জ্বালানির মাধ্যমে কনটেইনার প্রতি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমিয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকসই উন্নয়নবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হিদার উডন। এছাড়া কোম্পানিটি জ্বালানি মিশ্রণে বায়োমিথেন যোগ করছে। নিজেদের পদক্ষেপ ‘সঠিক’ উল্লেখ করে হিদার উড আরো জানিয়েছেন, একাধিক সবুজ জ্বালানিতে চলতে সক্ষম জাহাজ নির্মাণে দেড় হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে সিএমএ সিজিএম।

 

এলএনজি জীবাশ্ম জ্বালানি হলেও ক্রয়াদেশকৃত বেশির ভাগ ডুয়েল-ফুয়েল কনটেইনার জাহাজের এ সুবিধা চাওয়া হয়েছে। কারণ এটি প্রচলিত জ্বালানির তুলনায় ২৩ শতাংশ জিএইচজি নিঃসরণ কমাতে পারে। তবে পরিবেশবিদ ও জলবায়ু বিজ্ঞানীরা এলএনজির ব্যবহার নিয়ে উৎসাহী নন। কারণ এর উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবহারের সময় মিথেন গ্যাস লিক হতে পারে, যা জলবায়ু উষ্ণায়নে তীব্র প্রভাব ফেলে। একই আশঙ্কা প্রাণী ও উদ্ভিদ বর্জ্যনির্ভর নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

 

এমএসসি সমুদ্র বাণিজ্যে আট শতাধিক জাহাজ পরিচালনা করে। কোম্পানি বলছে, এলএনজির সরবরাহ চেইন তুলনামূলকভাবে নির্ভরযোগ্য ও নিশ্চিত। তারাও অন্যান্য কোম্পানির মতো এলএনজি পোড়াতে সক্ষম এমন দ্বৈত জ্বালানি জাহাজের অর্ডার দিচ্ছে। অন্যদিকে অ্যামাজন, আইকিয়া ও নাইকির মতো কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুসারে বায়োমিথেনে গুরুত্ব দিচ্ছে জার্মানির হ্যাপাগ-লয়েড।

 

আরো নিশ্চয়তা তৈরি করবে এবং আগামী দশকগুলোয় পরিবেশবান্ধব জ্বালানি বাজারে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে— এমন বৈশ্বিক নীতিমালা চান শিপিং জায়ান্টগুলোর নির্বাহীরা। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে নির্দিষ্ট সময়সীমা, কম কার্বনভিত্তিক জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহারে সরকারি প্রণোদনা এবং জ্বালানি রূপান্তরে দেরির জন্য শাস্তির বিধানও চান তারা।

 

গ্রিন মিথানল, অ্যামোনিয়া এবং সৌর ও বায়ুশক্তি থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেনভিত্তিক নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ করছে বেশকিছু কোম্পানি। গ্রিন মিথানলে চলতে সক্ষম জাহাজ কিনছে সিএমএ সিজিএম, মায়েরস্ক, এভারগ্রিন ও কসকো। এমএসসি নতুন এলএনজি জাহাজের একটি অংশে অ্যামোনিয়া ট্যাঙ্কও সংযোজন করছে। এ বিষয়ে কোম্পানির সিইও ভিনসেন্ট ক্লার্ক জানান, তাদের সামনে দুটি বিকল্প আছে। কোন জ্বালানিটি আগে আসে তার জন্য অপেক্ষা অথবা সবুজ জ্বালানিতে বিনিয়োগ।

পরিবেশবান্ধব কনটেইনার জাহাজ নির্মাণ বাড়লেও রয়ে গেছে জ্বালানির অনিশ্চয়তা