ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৩:১০:৩৬ পিএম

পাটপণ্য রপ্তানিতে দুর্দিন কাটছে না

২৯ জানুয়ারি, ২০২৫ | ৮:৩০ পিএম

পাটপণ্য রপ্তানিতে দুর্দিন কাটছে না

ছবি: সংগ্রহ

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় উৎপাদনসহ সার্বিক রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া সত্ত্বেও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের পণ্য রপ্তানি বেড়েছে। এতে আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি আয় প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়কালে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মৎস্য, প্লাস্টিক পণ্যসহ কয়েকটি খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় হোঁচট খেয়েছে। আগের অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে খাতটির রপ্তানি আয় ৮ শতাংশের বেশি কমেছে। এ খাতের প্রধান রপ্তানি পণ্য পাটের সুতার আমদানিও কমেছে ১৩ শতাংশের বেশি।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একসময় দেশের প্রধান অর্থকরী পণ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি গত তিন অর্থবছর থেকে টানা ধসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এতে রপ্তানি আয়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে পাট খাত। সরকারের নানা উদ্যোগেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না রপ্তানিমুখী খাতটি।

 

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, একক মাসের হিসাবে গত অর্থবছরের ডিসেম্বরে রপ্তানি আয়ে সামান্য প্রবৃদ্ধি হলেও চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) পাট খাতে রপ্তানি আয় ৮.১১ শতাংশ কমেছে। এ ছয় মাসে রপ্তানি হয়েছে ৪১ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের। যেখানে আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি আয় ছিল ৪৫ কোটি ৪২ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) ডিসেম্বরের চেয়ে ১.৪৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়কালে কাঁচাপাট ও বস্তা-ব্যাগের রপ্তানি আগের অর্থবছরের চেয়ে সন্তোষজনক হলেও সুতা ও অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।

 

একের পর এক রপ্তানিতে হোঁচটের পেছনে দেশের পাট খাতের অচলাবস্থাকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এস আহমেদ মজুমদার। তিনি বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে চাহিদা ও ক্রেতা রয়েছে, কিন্তু দেশে মিলগুলো থেকে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পাচ্ছেন না আমদানিকারকরা। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ বেসরকারি মিলে ২০ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতাও নেই। পণ্যের ঘাটতিতে রপ্তানি করা যাচ্ছে না। অথচ দেশে পুরনো মেশিনগুলো দিয়েই চাহিদা মেটানোর উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সেদিকে আমাদের নজর কম। আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ, উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো।

 

তিনি বলেন, ভারত আমাদের বড় বাজার ছিল। এন্টি ডাম্পিংয়ের কারণে সেটা কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। বর্তমানে সুদান, তানজানিয়া, উগান্ডাসহ আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে বিকল্প বাজার তৈরি হলেও উৎপাদন ঘাটতিতে ক্রেতা হারাতে হচ্ছে। এসব দেশে পাটের বস্তা ও সুতার বিপুল চাহিদা রয়েছে। কিন্তু একদিকে কাঁচামালের অভাব ও পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে খরচ বাড়ছে। প্রতিযোগিতায় ভারত, পাকিস্তানসহ অন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা পিছিয়ে পড়ছি।

 

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পাট খাতে সবচেয়ে বেশি আয় কমেছে এ খাতের প্রধান রপ্তানি পণ্য পাটের সুতায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩.২০ শতাংশ কমে ২৩ কোটি ১৪ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের যেখানে সুতা রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ২৬ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। একক মাসের হিসাবেও গত ডিসেম্বরে সুতার রপ্তানি আয় ৪.২০ শতাংশ কমেছে। গত ডিসেম্বরে পাটের সুতায় রপ্তানি আয় হয়েছে ৪ কোটি ২৪ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের ডিসেম্বরে যা ছিল ৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।

 

এ ছাড়া পাটের অন্যান্য রপ্তানি পণ্য মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে আয় হয়েছে ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮.১৬ শতাংশ কম। আগের অর্থবছরের প্রথমার্ধে রপ্তানি হয়েছিল ৫ কোটি ২৬ লাখ ডলার। একক মাসের হিসাবে গত ডিসেম্বর মাসে এ খাতে রপ্তানি ২০.৩৯ শতাংশ কমে ৭৭ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। আগের অর্থবছরে একই মাসে যা ছিল প্রায় ৯৮ লাখ ডলার।

 

পাটের সুতা তৈরিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানাগুলো শতভাগ সচল না থাকায় রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) তথ্যানুযায়ী, ৭৭ কারখানার মধ্যে মাত্র ৪৫টি সচল রয়েছে। কিন্তু সেগুলো নামে মাত্র। প্রকৃত অর্থে ২৫টিতে উৎপাদন স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে।

 

বিজেএসএর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও টিমেক্স জুট মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাপস প্রামাণিক বলেন, বর্তমানে এ খাতের অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছে। তার পরও আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছি। একদিকে কাঁচাপাটের দাম বেড়েছে। এতে সুতার উৎপাদন খরচও বেড়েছে। অন্যদিকে পলিথিনের সঙ্গে পাট পেরে উঠছে না। বিশ্ববাজারে ক্রেতারাও এখন বিকল্প সুতার দিকে ঝুঁকছে। আবার এ খাতে নীতিগত সহায়তা কমেছে। আগে রপ্তানিতে যে নগদ সহায়তা পাওয়া যেত, সেটি কমে গেছে। বিশ্ববাজারে আমরা ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছি। পাকিস্তান ও ভারত এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তান ইরানে সহজেই কম খরচে পণ্য পাঠাতে পারছে। সেখানে আমাদের বেশি খরচ পড়ছে, ফ্রেইট চার্জও বেড়েছে। অন্যদিকে দেশের বাজারেও চাহিদা বাড়ানো যায়নি। দেশে বাধ্যতামূলক পাটমোড়ক আইনও বাজারে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এটি হলেও এই খাত মন্দা সময় কাটিয়ে উঠতে পারত।

 

সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ভালো রপ্তানি আয়ের দেখা পায় পাট খাত। ওই অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে মোট রপ্তানি আয় হয় ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩১.৬৩ শতাংশ বেশি ছিল। এরপর থেকেই পাট রপ্তানিতে ধস নামতে থাকে, যা আর টেনে তোলা সম্ভব হয়নি। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, পরের ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি আয় ৩ শতাংশ কমে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ১৯.১ শতংশ কমে ৯১ কোটি ২২ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও রপ্তানিতে পিছিয়ে ছিল খাতটি।

পাটপণ্য রপ্তানিতে দুর্দিন কাটছে না