ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ১০:০১:০৩ এএম

প্রযুক্তির ব্যবহারে স্মার্ট হচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ১০:৫৭ এএম

প্রযুক্তির ব্যবহারে স্মার্ট হচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা

ছবি: সংগ্রহ

চিরাচরিত কৃষক চরিত্র গণি মিয়া ক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে স্মার্টফোন দিয়ে ড্রোন চালাবেন। ড্রোন উড়বে ফসলের মাঠজুড়ে। ছবি তুলবে ফসলের, মাটির। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সঙ্গে সঙ্গে গণি মিয়া জানবেন মাটির পুষ্টিগুণ। চোখের সামনে দেখতে পাবেন মাঠের কোনো অংশে কতুটুকু সার দিতে হবে; কোথায় কোথায় কোন কোন বালাইনাশক কি পরিমাণে লাগবে- দেখতে পাবেন সেই তথ্যও।

 

এটা কৃষি খাতে সরকারের এটুআই প্রকল্পের একটি কল্পিত চরিত্র। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বাস্তবে কৃষি এমন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে স্মার্ট কৃষিতে রূপান্তর ঘটবে। কৃষকও হবে স্মার্ট। ইতিমধ্যেই আধুনিক ব্যবস্থাপনায় কৃষিকে স্মার্ট রূপদানে যার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

 

অনেক আগেই সনাতনি পদ্ধতির কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। কৃষকের মেধার উন্মেষ ঘটেছে; সময়ের সঙ্গে ধারণা পাল্টে গেছে আমূল। ঘটেছে চাষাবাদের পরিবর্তন। বাণিজ্যিক ও যান্ত্রিকীকরণে বিপ্লব ঘটছে কৃষিতে। ক্ষেতে চাষ করা, ফসল রোপণ, পরিচর্যা, সার-বালাইনাশক প্রয়োগ, ফসল কাটা, ঝাড়াই-মাড়াই প্রভৃতি কাজে ব্যবহার হচ্ছে যন্ত্র। ফসল উৎপাদনসহ কৃষিতে শুরু হয়েছে অন্যান্য প্রযুক্তির ব্যবহারও। এখন আর রেডিও নেই। সবার হাতে এন্ড্রোয়েড মোবাইল ফোন সেট। আছে কৃষকের হাতেও। এতে আছে ইন্টারনেট সংযোগ। এন্ড্রোয়েডের মাধ্যমে তারা কৃষি সম্পর্কিত তথ্যে জানতে পারছেন।

 

এর মাধ্যমে এখন আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও ফসল আবাদসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শও পাচ্ছেন। যোগাযোগ করতে পারছেন কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রতিষ্ঠিত কৃষি কল সেন্টার এবং গ্রাম পর্যায়ে স্থাপিত ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রে। ইউটিউব ও ওয়েব পোর্টালে কৃষি বিষয়ক তথ্যচিত্রের মাধ্যমেও সমৃদ্ধ হচ্ছেন কৃষক। আছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তৈরি ‘খামারি অ্যাপস’, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ‘ডা. চাষী’ অ্যাপসের মতো কৃষি সম্পর্কিত নানান মাধ্যম। ফসলের ক্ষেতে বা ঘরে বসেই কৃষক মুহূর্তে জানতে পারেন কৃষির যাবতীয়। এমনকি ফসল বেচাকেনাও করতে পারছেন। পারছেন মোবাইল ফোনে বাজারে কৃষিপণ্যের দাম জানতে। এসবের পাশাপাশি কৃষিতে সমন্বয় ঘটছে আরো উন্নত প্রযুক্তি। 

 

 ইতোমধ্যে রাজশাহী অঞ্চলে মাটিতে সেন্সর ব্যবহার করে ফসলে সার প্রয়োগ ও সারের অতিরিক্ত ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। বরিশাল অঞ্চলে জিপিএস নির্দেশিত ট্রাক্টরের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা ১২ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে। আইওটি ডিভাইস ঢাকার কৃষকদের ফসলের সেচের চাহিদা নির্ণয় করতে সাহায্য করছে, যাতে পানির ব্যবহার ২০ শতাংশ কমেছে।

 

চট্টগ্রামে ড্রোন প্রযুক্তিতে ধান পর্যবেক্ষণ করে ফলন সঠিক রেখে কীটনাশকের ব্যবহার ৩০ শতাংশ কমানো গেছে। বায়বীয় সমীক্ষায় মাটির উর্বরতা কম আছে এমন এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, ফলে ভবিষ্যতে ফসল রোপণের পরিকল্পনার অগ্রগতি হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে বপনের সময় নির্ধারণ করার ফলে জামালপুর জেলায় ১০ শতাংশ ফলন বাড়ছে। আর পাবনা অঞ্চলে রোগের পূর্বাভাসগুলো- যেমন গমের মরিচা রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে কৃষকদের আগে থেকে সতর্ক করা হচ্ছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে কৃষিতে ঘটবে প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার। রোবটের ব্যবহার বাড়বে। বিশেষ করে উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ খাতে কর্মসংস্থান সংকুচিত করবে। স্মার্ট কৃষি খামার ব্যবস্থা ফসলের উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতের কৌশল এবং কৃষিতে টেকসই পরিবর্তন আনবে। 

 

কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীরা জানান, কৃষি খাতে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বড় চ্যালেঞ্জ কৃষি জমি কমে যাওয়া। বছরে এক শতাংশ হারে কমছে কৃষি জমি। কৃষি জমি ৮৮ লাখ হেক্টরেরও বেশি থেকে কমে বর্তমানে প্রায় ৮০ লাখ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। আরেকটি প্রধান সমস্যা কৃষিশ্রমিক সংকট। যা কয়েক বছর ধরে কৃষিতে দৃশ্যমান হয়েছে। এক সময়ে দেশে ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখন কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা নেমেছে ৪৫ শতাংশের নিচে। তাদের মজুরি বেড়েছে। এতে কৃষি লাভজনক হচ্ছে না। কৃষকের গড় আয়ু কমে দাঁড়িয়েছে ৫৪ বছরে। বর্তমানে দেশে শিক্ষার হার প্রায় ৭৮ শতাংশ। ক্রমশ শিক্ষার হার বাড়ছে। তাই কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় কৃষি কাজে সম্পৃক্ত হতে চায় না শিক্ষিত জনগোষ্ঠীসহ নতুন প্রজন্ম। 

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ঘটছে। আটা-ময়দার রুটি, ভালো মানের চালের ভাত এবং মসলা জাতীয় খাবারের চাহিদা বাড়ছে। এর যোগান দিতে হলে অধিক খাদ্য উৎপাদনে যেতে হবে দেশকে। আর সেজন্য প্রস্তুতিও নিতে হবে আগে থেকেই। ‘আবাদ করব, খাবো’- পেটে-ভাতের সেই কৃষি এখন আর নেই। কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিকল্প নেই। মাঠের বিদ্যমান আর্দ্রতায় উপযোগী ফসল উৎপাদন করতে হবে। স্মার্ট কৃষি হলে কৃষক লাভবান হবেন। ভোক্তারাও লাভবান হবেন। সার ব্যবহার কমে যাবে। উৎপাদন খরচ কমে যাবে। ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমে যাবে। অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি খাতকে সমৃদ্ধ করতে এবং জলবায়ু পরিববর্তনজনিত ঝুঁকি, সমূহ সমস্যা-সংকট মোকাবিলায় স্মার্ট কৃষিতে রূপান্তরের উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। 

 

স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষি বিজ্ঞানী ড. মো. আব্দুল মজিদ ভোরের কাগজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের হুমকি আছে। সেই হুমকি মোকাবেলায় আগামীতে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা বজায় রাখতে স্মার্ট কৃষি একটি বড় ইস্যু।

 

কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফল বাস্তবায়ন দরকার। আমাদের স্মার্ট কৃষক তৈরি করতে হবে। কৃষক গ্রুপের মধ্যে থাকা এন্ড্রোয়েড ফোন দিয়ে ফ্রেমিংয়ের মধ্যে নিয়ে ছবি তুলে দিলে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে- কি পোকার আক্রমণ হয়েছে বা কি ওষুধ লাগবে। তাহলেই ওই কৃষক স্মার্ট কৃষক হবেন। এটার জন্য আলাদা কোনো প্রকল্পের দরকার নেই। পার্টনারসহ বিদ্যমান প্রকল্পে এটা সমন্বয় করা সম্ভব।

 

আব্দুল মজিদ বলেন, প্রয়োজনীয় তথ্য সংবলিত কৃষকের জন্য স্মার্ট কার্ড তৈরি করা এখন সময়োপযোগী। এতে কৃষকের জমির পরিমাণ ও ধরন (উঁচু, মাঝারি, নিচু) নির্ধারণ করা থাকবে। এটা জানতে পারলে সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা হাতে নেয়া যাবে। অর্থাৎ জমির ধরন অনুযায়ী ফসল বিন্যাস (কোন জমিতে কি ফসল উৎপাদন) করতে পারবেন কৃষক। তাদের আধুনিক কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন কৃষক গ্রুপ আছে।

 

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) সরেজমিন গবেষণা বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান ড. মাজহারুল আনোয়ার ভোরের কাগজকে বলেন, ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার তিনটি ভিত্তির উপর গঠিত। প্রথমত এতে ফলন বেশি হবে। দ্বিতীয়ত খরচ কম হবে এবং তৃতীয়ত এটা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাবে। পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। মাঠের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যে ফসল ফলানো যাবে তাই করা হচ্ছে। গতানুগতিক কৃষিতে থাকব না। আধুনিক কৃষিতে টার্ন নিচ্ছি। আমরা এখন টার্নিং পয়েন্টে আছি।

প্রযুক্তির ব্যবহারে স্মার্ট হচ্ছে কৃষি ব্যবস্থা