ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ১০:২৪ এএম
অনলাইন সংস্করণ
বছর শেষে জেগেছে আশা
২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ১০:২৪ এএম

ছবি: সংগ্রহ
আশির দশকের শুরুতে মাত্র ১২ হাজার ডলার রপ্তানি আয় দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প। এই শিল্পই এখন দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসছে তৈরি পোশাক থেকে। অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক নারীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পোশাক খাত ভূমিকা রাখছে দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনেও। তবে ২০২৪ সালে এসে দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই চালিকাশক্তিটিকে বেশ উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বছরের শুরু থেকে কয়েকবার পোশাক খাতে অস্থিরতা বিরাজ করে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি ন্যূনতম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন দাবিতে শ্রমিকদের রাস্তায় নামা এবং বেশ কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ সরকার সারাদেশের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এতে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের। দুই দফায় সরকার সব শিল্প কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। ফলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েন মালিকরা। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাজার হাজার শ্রমিক অংশগ্রহণ করে। এই আন্দোলনে অনেক শ্রমিক নিহত হন। অনেকে আহত হন। কিন্তু আন্দোলন সফল হলেও এসব শ্রমিকের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পোশাক খাতে চরম অস্থিরতা নেমে আসে। কারখানা মালিকদের নামে মামলা, হামলা, চাঁদাবাজি, দখল, শ্রমিকদের সঙ্গে বৈষম্যের অভিযোগে নানা দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে শ্রমিকরা। বিভিন্ন কারখানায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। মামলা, হামলা ও চাঁদা দাবি ইত্যাদি মাথায় নিয়ে অনেক মালিক দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যান।
উল্লেখ্য, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঠিক করতে গত এপ্রিলে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। গত ২২ অক্টোবর
এই বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করে। আর মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়। তবে মালিক পক্ষের প্রস্তাবের খবর ছড়িয়ে পড়লে ২৩ অক্টোবর থেকে গাজীপুরে আন্দোলন শুরু করে পোশাক শ্রমিকরা। পরে তা নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া, সাভার ও ঢাকার মিরপুরে ছড়িয়ে পড়ে।
অনেক জায়গায় শ্রমিকরা ভাঙচুর শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে শতাধিক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময় ৭ নভেম্বর পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার ঘোষণা দেয় সরকার। সরকারের এই সর্বনিম্ন মজুরি ঘোষণার পর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসতে থাকে শিল্পাঞ্চলগুলো। পরে বছরের শেষের দিকে পোশাক কারখানাগুলোতে শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করছে। কাজ চলছে পুরোদমে। ক্রেতাদের মধ্যেও আস্থা ফিরে আসছে। নতুন নতুন অর্ডার আসছে। পাঁচ মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে রপ্তানিও বাড়ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকেই দেশের তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা শুরু হয়। বেতন বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ। পরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন করে অস্থিরতা নেমে আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর পদক্ষেপে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে ধীরে ধীরে রপ্তানি বাড়ছে এমন চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে। গত পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) সামগ্রিক পণ্য রপ্তানির ৮১ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ১ হাজার ৬১২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। শুধু নভেম্বরেই ১৭৪ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। অন্যদিকে গত মাসে ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১৫৭ কোটি ডলারের। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ। এ ছাড়া পোশাক রপ্তানির বড়বাজার ইউরোপেও আগের তুলনায় রপ্তানি বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর এই দশ মাসে ইউরোপে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে এক দশমিক ৪৩ শতাংশ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ২০২৪ সাল কেটেছে। এখন স্বাভাবিকের পথে। রপ্তানিও আগের তুলনায় ভালোর দিকে। তবে ২০২৫ সাল ভালো যাবে বলে আশা করা যায়। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারপ্রধানের কাছে ব্যবসায়ীদের অনেক প্রত্যাশা। তিনি বিশ^ নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করলে কেউ ফেলে দেবে না। তিনি বিশ^নেতাদের অনুরোধ করলে বিশ^বাজারে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প শক্ত অবস্থানে যেতে পারবে বলে আমাদের বিশ্ব।
জানা গেছে, এক বছরে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত ৭৬টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানায় কাজ করা ৫১ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দিতে পারছে না অন্তত ১৫৮টি কারখানা। এ ছাড়া নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সদস্যভুক্ত এক বছরের মধ্যে এই খাতের ৫০টির বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ৩৫ হাজারের বেশি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সদস্যভুক্ত ১৪টি বৃহৎ কারখানা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করা প্রায় আট হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার, কাঁচামাল আমদানিতে এলসি সমস্যা, শিল্পে অব্যাহত গ্যাস সংকট, গ্যাস ট্যারিফ বৃদ্ধি করা, বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ না পাওয়া, অব্যাহতভাবে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ায় অনেকে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। আবার অনেকে কারখানায় শ্রমিকদের বেতন দিতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন।
