ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৯:৩৭ এএম
অনলাইন সংস্করণ
বন্ড লাইসেন্সবিহীন ছোট রপ্তানিকারকদের জন্য শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি সহজ করতে চায় এনবিআর
রপ্তানিকারকরা এনবিআরের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও, অনেকেই আরও নমনীয় ব্যবস্থা চাচ্ছেন।
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৯:৩৭ এএম

ছবি: সংগ্রহ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সবিহীন ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকদের প্রযোজ্য করের বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টি ব্যবহার করে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এর লক্ষ্য রপ্তানি বৃদ্ধি, বৈচিত্র্যকরণকে উৎসাহিত করা এবং ব্যবসা পরিচালনাকে সহজ করা।
প্রাথমিকভাবে, এনবিআরের শুল্ক শাখা বার্ষিক ৫ মিলিয়ন ডলারের কম রপ্তানিকারকদের এ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে, যা আগামী জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, রাজস্ব কর্তৃপক্ষ ২৩ জানুয়ারি সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্ভাব্য প্রক্রিয়া পর্যালোচনার জন্য বৈঠক করেছে এবং তিন সপ্তাহের মধ্যে সুপারিশ তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে।
"ইস্পাত, আসবাবপত্র ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের কিছু উদ্যোক্তা ইতোমধ্যে এ সুবিধার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। আমরা এখন বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সের বিকল্প হিসেবে এটি সব রপ্তানিকারকের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে চালু করার বিষয়ে ভাবছি," বলেন বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এনবিআরের এক কর্মকর্তা।
এনবিআরের কাস্টমস বন্ড অ্যান্ড আইটি সদস্য মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে কে (টিবিএস) বলেন, "আমরা পরিকল্পনা করছি, কাঁচামাল আমদানির শুল্কের সমপরিমাণ ব্যাংক গ্যারান্টি নিশ্চিত করে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় কাঁচামাল ছাড় করা হবে।"
"যদি সেই কাঁচামাল ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করা হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রমাণস্বরূপ প্রসিড রিয়েলাইজেশন সার্টিফিকেট জমা দেওয়া হয়, তাহলে ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড় করা হবে," তিনি যোগ করেন।
মোয়াজ্জেম হোসেন আরও জানান, বন্ড লাইসেন্সবিহীন কারখানাগুলোর বার্ষিক রপ্তানি বর্তমানে ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
কাঁচামাল আমদানি সহজ করতে সরকার শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দিচ্ছে, তবে শর্ত হচ্ছে—এই উপকরণ নির্ধারিত গুদামে সংরক্ষণ করতে হবে এবং পুরোপুরি রপ্তানির জন্য ব্যবহার করতে হবে। এই ব্যবস্থা বন্ডেড ওয়্যারহাউস নামে পরিচিত।
তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স পেতে কঠোর শর্ত পূরণ করতে হয় এবং 'অতিরিক্ত খরচ' বহন করতে হয়, যা ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকদের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। ফলে, অনেকেই এ সুবিধা নিতে আগ্রহী নন।
আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বছরে ২০ হাজারের বেশি রপ্তানিকারক ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালান, যদিও সবার কাঁচামাল আমদানির প্রয়োজন হয় না। তবে তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক ও অন্যান্য খাতের মাত্র ছয় হাজার কারখানা বন্ড সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করতে পারে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রায় ৮৭ ধরনের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৪৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করেছে, যার ৮০ শতাংশের বেশি এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
'সহজতর বিকল্প' চান রপ্তানিকারকরা
রপ্তানিকারকরা এনবিআরের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও, অনেকেই আরও নমনীয় ব্যবস্থা চাচ্ছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, "বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি ভালো খবর, যদিও আমাদের এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স পেতে অক্ষম রপ্তানিকারকদের জন্য শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির একটি সহজতর ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়ে আসছি।"
তবে তিনি ব্যাংক গ্যারান্টির পরিবর্তে আরও সহজলভ্য বিকল্পের আহ্বান জানান, কারণ এটি সব রপ্তানিকারকের জন্য বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে।
"অনেক সময় ব্যাংকগুলো সব ধরনের রপ্তানিকারকের জন্য গ্যারান্টি দিতে চায় না। এছাড়া, রপ্তানিকারকদের বড় অঙ্কের অর্থ জামানত হিসেবে জমা এবং ব্যাংককে কমিশন দিতে হয়, যা ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে," তিনি বলেন।
মোহাম্মদ হাতেম পরামর্শ দেন, এনবিআর ব্যাংক গ্যারান্টির পরিবর্তে ভ্যাট অফিসের অডিট রিপোর্ট গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে, কারণ সমস্ত রপ্তানিকারকই ওই অফিসে নিবন্ধিত।
বর্তমানে, রপ্তানির পর আমদানি করা কাঁচামালের ওপর প্রদত্ত শুল্ক ফেরতের একটি ব্যবস্থা চালু আছে, যা ডিউটি ড্রব্যাক নামে পরিচিত।
যদিও রপ্তানিকারকরা এনবিআরের শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তর (ডেডো)-এর মাধ্যমে পূর্বে পরিশোধিত আমদানি কর ফেরতের জন্য আবেদন করতে পারেন, তবে প্রক্রিয়াটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। বিপুল পরিমাণ নথিপত্র জমা দেওয়া, দীর্ঘ প্রক্রিয়াকরণ সময় এবং অতিরিক্ত খরচের কারণে অনেক রপ্তানিকারক এতে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
ফলে, ডেডোর মাধ্যমে রিফান্ড আবেদন করা থেকে অনেকেই বিরত থাকছেন বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
ব্যবসার খরচ কি কমবে?
এনবিআরের কাস্টমস বন্ড ও আইটি সদস্য মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, নতুন এই উদ্যোগ ব্যবসা পরিচালনা সহজ করার পাশাপাশি খরচও কমাতে সহায়ক হবে।
"যদি এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হবে এবং রপ্তানির বৈচিত্র্য বাড়বে," বলেন তিনি। তার মতে, চলতি অর্থবছরের মধ্যেই এ সুবিধা কার্যকর হতে পারে।
তবে কিছু রপ্তানিকারকের মতে, বন্ড লাইসেন্সের বিকল্প হিসেবে ব্যাংক গ্যারান্টি দিলেও ব্যবসার খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে না বা প্রক্রিয়া সহজ হবে না।
দেশের অন্যতম বৃহৎ পাটজাত পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, ব্যাংক গ্যারান্টি নিশ্চিত করা সবার জন্য সহজ নয়।
"এটি পেতে বড় অঙ্কের অর্থ জামানত হিসেবে জমা রাখতে হয়, পাশাপাশি ব্যাংকের কমিশনও দিতে হয়," বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "রপ্তানিকারকের রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থকে ব্যাংক গ্যারান্টি হিসেবে বিবেচনা করা আরও বেশি বাস্তবসম্মত পদ্ধতি হতে পারে।"
তবে, কিছু রপ্তানিকারক বলছেন, তাদের অধিকাংশেরই ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তহবিল নেই।
বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সহ-সভাপতি নাসির খানও মনে করেন, বাধ্যতামূলক ব্যাংক গ্যারান্টি ব্যবসার খরচ কমাবে না।
তিনি এমন একটি ব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়েছেন, যা কঠোর শর্ত ছাড়াই কাঁচামাল আমদানির অনুমতি দেবে, তবে তার জন্য বছর শেষের মধ্যেই নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য সংযোজনসহ রপ্তানি নিশ্চিত করতে হবে।
"ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের মতো দেশে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির জন্য বন্ড লাইসেন্স বা অন্য কোনো কঠোর শর্ত নেই। তারা শুধু নিশ্চিত করে যে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অতিরিক্ত রপ্তানি নির্ধারিত শতাংশ — ধরা যাক ৩০ শতাংশ — অর্জিত হয়েছে কি না। আমরাও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি," বলেন তিনি।
সম্ভাব্য অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কেবল ব্যাংক গ্যারান্টির ভিত্তিতে শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমোদন দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, "শুল্ক বিভাগ বর্তমানে বন্ড লাইসেন্সধারী কারখানাগুলোর অনিয়ম পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা তৈরি করছে। কিন্তু যদি বিপুল সংখ্যক নতুন কারখানাকে শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়, তাহলে কীভাবে নিশ্চিত করা হবে যে, আমদানিকৃত কাঁচামাল রপ্তানির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, স্থানীয় বাজারে নয়?"
তিনি আরও বলেন, "এনবিআরের সক্ষমতা শক্তিশালী করার পরেই এ সুবিধা চালু করা উচিত।"
এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. লুফতর রহমান উদ্যোগটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন, তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, "যদি আমদানি-রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাল না করা হয়, তাহলে কেবল 'প্রসিড রিয়েলাইজেশন সার্টিফিকেট' (পিআরসি) যাচাই করেই রপ্তানির সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।"
তিনি আরও বলেন, "স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করে এ সুবিধা চালু করলে অপব্যবহারের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকবে।"
এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে (টিবিএস)-কে বলেন, "পিআরসি থাকলেও রপ্তানিকৃত পণ্য আসলেই শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় আমদানিকৃত কাঁচামাল ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।"
