ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৮:০৫:৫৭ এএম

বন্ধ হচ্ছে ব্যবসা, বাড়ছে মন্দ ঋণ

২১ অক্টোবর, ২০২৪ | ১:১১ পিএম

বন্ধ হচ্ছে ব্যবসা, বাড়ছে মন্দ ঋণ

ছবি: সংগ্রহ

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কয়েক মাস ধরে এক ধরনের অচলাবস্থা চলছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই চলা এই স্থবিরতা এখন আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে। সরকারের হিসাবে বলা হয়েছে— একদিকে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অপরদিকে বাড়ছে মন্দ ঋণের পরিমাণ।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত আসছে কম। শুধু তাই নয়, এক বছরে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে—২০২৩ সালের শেষে ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে আছে খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল করা ঋণ ও রাইট-অব ঋণ। তবে চলতি বছরের জুনে এর পরিমাণ আরও অন্তত এক লাখ কোটি টাকা বাড়তি যোগ হবে। কারণ বিদায়ী সরকারের শেষ সময়ে ব্যাংক থেকে পানির স্রোতের মতো টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে।


২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৩ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের শেষে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩.৭৮ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১.০৯ লাখ কোটি টাকা।


অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মতো ইস্যুগুলো ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমাতে পারে। ফলে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের সম্পদের মানের অবনতি হতে পারে।

 

ব্যাংকাররা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ব্যাংক খাতে ব্যাপক হারে লুটপাট হয়েছে। এস আলমসহ অনেক প্রভাবশালী গ্রুপ নামে বেনামে লাখ লাখ কোটি টাকা ঋণের নামে নিয়ে গেছে—যার বেশিরভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পরে এসব ঋণ খেলাপি না দেখাতে পুনঃতফসিলের করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পলাতক সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উদার নীতির কারণে ঢালাওভাবে ঋণ পুনঃতফসিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই সময় পুনঃতফসিল করা ঋণ পুনরায় খেলাপি হতে শুরু করেছে।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, চার-পাঁচটি পরিবার ব্যাংক থেকে দুই লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে।

 

এদিকে নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের মাস আগস্টে ৪৬টি কোম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। পরের মাস সেপ্টেম্বরে বন্ধ হয়েছে আরও ২৬টি কোম্পানি। যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদফতরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ মাসে (মে থেকে সেপ্টেম্বর) ১২৮টি কোম্পানি বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ) ৮৩টি কোম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আগের সরকারের সুবিধাভোগী অনেক ব্যবসায়িক পৃষ্ঠপোষক ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, যার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি স্থবির অবস্থায় রয়েছে।

 

 

ইউরোপে জানুয়ারি-জুলাই সময়ে মোট আমদানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশ থেকে বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু চীন থেকে বেড়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারত থেকে বেড়েছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, কম্বোডিয়া থেকে বেড়েছে ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ভিয়েতনাম থেকে বেড়েছে ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং পাকিস্তান থেকে বেড়েছে ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। আর তুলনামূলক রফতানি প্রবৃদ্ধির বিচারে চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং ভারতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় প্রবৃদ্ধিতে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি। যেটি এসব দেশে রফতানি আদেশ শিফট হয়ে যাওয়াকে ইঙ্গিত করে।

 

রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে নির্দিষ্ট কিছু শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতার কারণে শুধু সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের প্রায় ২৫০-৩০০ মিলিয়ন ডলারের রফতানি ও উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।’

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কিছু কোম্পানির ব্যবসা করার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতির চাপে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, বিক্রি কমে যাওয়া, সুদের উচ্চ হার, শ্রম অসন্তোষ, পরিবহন ও কারিগরি সমস্যা, ডলার সংকটে কাঁচামালের ঘাটতি, বৈশ্বিক যুদ্ধ ও আকস্মিক বন্যার বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের।

 

কোম্পানিগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী—স্থায়ীভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এরইমধ্যে ১৬০টির মতো কোম্পানি বন্ধের প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আরজেএসসিতে বন্ধের আবেদনসহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে। আবার কিছু কোম্পানি সাধারণ সভার বৈঠকে প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।

 

বন্ধের তালিকায় ছোট প্রতিষ্ঠান যেমন রয়েছে, তেমনই বড় গ্রুপের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদফতরে নিবন্ধিত এসব কোম্পানির মধ্যে পণ্য সরবরাহ ও সেবাদানকারী উভয় খাতের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে নিবন্ধন নেওয়া কোম্পানিও বন্ধের তালিকায় আছে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা মোট ঋণের প্রায় ৩২ শতাংশই দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ ছিল। এই পরিসংখ্যান আগের বছরের তুলনায় প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বা ২৬ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৬ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ মোট বিতরণকৃত ঋণের ১২ শতাংশের কম। তবে এস আলম গ্রুপের ঋণসহ বড় ঋণগুলো বিবেচনায় নিলে খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে।

 

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দুর্ভাবনার বিষয় যে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ (এনপিএল) ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের এনপিএল ২ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি হলেও এস আলমসহ কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণ এনপিএলে পরিণত হলে—সেটি ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা হয়ে যেতে পারে। এই পরিমাণটা হবে আইনি কাঠামোসহ বিভিন্ন জায়গায় থাকা ঋণগুলো বাদেই।’

 

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে যে খেলাপি ঋণ হিসাব করা হয়নি, সেগুলো এর সঙ্গে যোগ করা হলে মন্দ ঋণ আরও বেশি হতো।’ তিনি বলেন, ‘একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমর্থনে লুটপাট হয়েছে, অপরদিকে বড় ঋণগ্রহীতারা তাদের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে ঋণ সুবিধা নিয়েছে, কিন্তু ফেরত দেয়নি। ফলে ব্যাংকগুলো এখন চাপে পড়েছে।’

 

এদিকে যাচাই-বাছাই না করে ঋণ বিতরণ করায় বেশ কয়েকটি ব্যাংক এখন চাপে পড়েছে। কয়েকটি ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা সময়মতো ফেরত দিতে পারছে না। এছাড়া দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ৮২২ কোটি টাকা বেড়েছে। গত জুনের শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা এই খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ৩৩.১৫ শতাংশ।