ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ১১:২২ এএম
অনলাইন সংস্করণ
বিপদের সঙ্কেত! বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র নিঃশেষের দ্বারপ্রান্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ১১:২২ এএম
![বিপদের সঙ্কেত! বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র নিঃশেষের দ্বারপ্রান্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2024/09/21/20240921111402_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন গ্যাস যুক্ত হচ্ছে ২ হাজার ৫৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে মার্কিন কোম্পানি শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে আসছে ১ হাজার ২ মিলিয়ন ঘনফুট বা ৩৯ শতাংশ। যদিও জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের বৃহত্তম এ উৎসের মজুদ এরই মধ্যে নিঃশেষ হয়ে পড়ার কথা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিবিয়ানা থেকে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে তা দেশের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে মারাত্মক বিপর্যয়ে ফেলতে পারে।
গ্যাস মজুদের টুপি হিসাব অনুযায়ী, বিবিয়ানায় গ্যাসের মজুদ থাকার কথা প্রায় ছয় ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। যদিও এরই মধ্যে এখান থেকে উত্তোলন ছয় টিসিএফ ছাড়িয়েছে। শেভরনের পক্ষ থেকে গত বছর মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ৪৮১ বিলিয়ন কিউবিক ফুট (বিসিএফ) গ্যাস মজুদের কথা জানানো হয়।
পেট্রোবাংলা সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এ মজুদও বিবিয়ানার। সংস্থাটির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, এরই মধ্যে সেই গ্যাসেরও সিংহভাগ উত্তোলন হয়েছে। সে অনুযায়ী দেশের গ্যাস উত্তোলনে শীর্ষে থাকা ক্ষেত্রটির মজুদ এখন নিঃশেষের কাছাকাছি।
দেশে উত্তোলিত গ্যাস ছাড়াও জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন এলএনজি যুক্ত হওয়ার কথা দৈনিক ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এ এলএনজির পুরোটাই আমদানিনির্ভর।
জাতীয় গ্রিডে দিনে ৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি সরবরাহ দেয়া যায়নি। টার্মিনালটি সচল হলেও এখন এলএনজি আমদানি না থাকায় এ সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। এলএনজির সরবরাহ না থাকায় এরই মধ্যে চাপে পড়েছে দেশের শিল্প, বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদন।
গ্যাস মজুদের প্রাথমিক প্রাক্কলিত হিসাব জিআইআইপি অনুযায়ী, বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে মোট মজুদের পরিমাণ ৮ হাজার ৩৮৩ বিসিএফ। তবে এ গ্যাসের পুরোটাই উত্তোলনযোগ্য নয়। ভূতত্ত্ববিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্যাস রিকভারি ফ্যাক্টর অনুযায়ী এ ধরনের গ্যাস ক্ষেত্রে মোট মজুদের ৭০ শতাংশ উত্তোলনযোগ্য।
বিবিয়ানায় চিহ্নিত মজুদের বাইরে গ্যাসের আর কোনো বড় মজুদ আছে কিনা, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। জ্বালানি বিভাগ কিংবা পেট্রোবাংলা থেকে বিবিয়ানায় নতুন মজুদ শনাক্ত হওয়ার বিষয়ে কোনো ঘোষণাও দেয়া হয়নি। তবে সেখান থেকে উত্তোলনযোগ্য আরো ১-২ টিসিএফ মজুদ পাওয়া গেলে, তা দেশের জ্বালানি খাতে গ্যাস সংকটের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শেভরনের পক্ষ থেকে গ্যাস মজুদের একটি প্রতিবেদন পেট্রোবাংলায় জমা দেয়া হয়েছিল। সেখানে গ্যাসের রিজার্ভের একটি তথ্য জানানো হয়েছে। তবে সেটি খুব বেশি নয়। এটি জ্বালানি বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রে প্রমাণিত গ্যাসের মজুদ ৫ হাজার ৭৫৫ বিসিএফ। মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে জমা দেয়া শেভরন করপোরেশনের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, রিজার্ভের ব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশে তাদের অধীন গ্যাস ক্ষেত্রে মজুদ বেড়েছে ৪৮১ বিলিয়ন ঘনফুট।
সুনির্দিষ্টভাবে সেখানে শেভরন কোনো গ্যাস ফিল্ডের কথা উল্লেখ না করলেও পেট্রোবাংলার নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, এ মজুদ বিবিয়ানা ফিল্ডেরই। সে অনুযায়ী এখানে মোট মজুদ ৬ হাজার ২৩৬ বিসিএফ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ৯৭৫ বিসিএফ এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরো অন্তত ৮৭ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হবে বিবিয়ানা থেকে। সব মিলিয়ে ৬ হাজার ৬২ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হবে চলতি মাস পর্যন্ত। ফিল্ডটিতে তাহলে আর অবশিষ্ট থাকবে ১৭৪ বিসিএফের মতো।
দেশের জাতীয় গ্রিডে বর্তমানে সরবরাহ দৈনিক ২ হাজার ৫৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে বিবিয়ানা ফিল্ডের সরবরাহ ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের ওপরে রয়েছে। উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শেভরনও। তবে জাতীয় গ্রিডে এ মুহূর্তে বিবিয়ানার গ্যাসের কোনো বিকল্প নেই।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে হ্রাস পেলে কিংবা আকস্মিকভাবে বন্ধ হলে দেশের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে।
যদিও দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ আইন স্থগিত থাকায় এখন আগের মতো চাইলেও দ্রুততার সঙ্গে এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা আশাবাদী, শিগগিরই হয়তো এ সংকট কমে আসবে।
সিলেট অঞ্চলে কাজের পরিধি বাড়াতে ২০২২ সালের অক্টোবরে পেট্রোবাংলার সঙ্গে তিনটি চুক্তি করে শেভরন। চুক্তির আওতায় কোম্পানিটি বিবিয়ানায় নতুন জায়গা পায়। মৌলভীবাজার ও জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রের গ্যাস ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির মেয়াদও বাড়িয়ে নেয় কোম্পানিটি। বর্তমানে জালালাবাদ ও বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্রের সঙ্গে চুক্তির সময়সীমা রয়েছে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাসের প্রাথমিক মজুদ আবিষ্কারের পর এর হিসাব যে আরো বড় হবে না, তা বলা যাবে না। গ্যাস উত্তোলন শুরু হওয়ার আগে এক ধরনের হিসাব থাকতে পারে। উত্তোলন শুরু হওয়ার পর অন্য রকম হতে পারে।
দেশে গ্যাস সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর রূপ নিচ্ছে। এরই মধ্যে চাপে পড়েছে শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানার উৎপাদন। বিপাকে পড়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। বিশেষ করে উৎপাদনমুখী বৃহৎ শিল্পগুলোয় ভোগান্তির মাত্রা সবচেয়ে বেশি। দেশে উৎপাদনমুখী শিল্পের সঙ্গে জড়িত মোট কর্মসংস্থানের ৬৮ শতাংশই বৃহৎ শিল্পে। কাঁচামালের ৬৩ শতাংশ ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির ৫৬ শতাংশই ব্যবহার করে এ শিল্পগুলো।
কখনো কখনো সিরামিক খাতের কারখানাগুলোয় উৎপাদন ক্ষতি ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রচুর কাঁচামালও নষ্ট হচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে বস্ত্র শিল্পেও উৎপাদন সক্ষমতার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে। এ কারণে নির্ধারিত সময়ে ক্রেতার কাছে পণ্য পাঠানোর বিষয়টিও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে।
বিদ্যুৎ খাতেও সংকট বড় আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে দিন ও রাত মিলিয়ে গড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। প্রয়োজনীয় গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেক বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।
একইভাবে ব্যাহত হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার সার কারখানার উৎপাদন। এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে দুটি কারখানার উৎপাদন। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না হলে যথাসময়ে কৃষককে সার সরবরাহ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে সার উৎপাদন কম হবে সাড়ে তিন লাখ টন। ফলে ঘাটতি পূরণে সরকারকে ব্যয় করতে হবে অতিরিক্ত ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
- ট্যাগ সমূহঃ
- গ্যাস
![বিপদের সঙ্কেত! বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র নিঃশেষের দ্বারপ্রান্তে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)