ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৯:৪৩:২০ এএম

বোরো মৌসুমের আগে কৃষিঋণ বিতরণ কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৭:০ পিএম

বোরো মৌসুমের আগে কৃষিঋণ বিতরণ কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি

ছবি: সংগ্রহ

দুটি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমনের উৎপাদন। বোরোয় এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার প্রত্যাশা করছিলেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য কৃষি খাতে সহজ শর্তে সুলভ ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হচ্ছিল বেশি। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বোরো মৌসুমের আগে দেশের কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দেশের কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি।


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ব্যাংকগুলো চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পেরেছে ১৩ হাজার ৮১ কোটি টাকা। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে কৃষি খাতে মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ২৮০ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে দেশের কৃষি খাতে মোট ৩৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বিতরণ কমলেও অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে কৃষি খাত থেকে ঋণ আদায় বেড়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে খেলাপির হারও কৃষি খাতেই সর্বনিম্ন।


এর পরও ব্যাংকগুলোর কৃষিঋণের বিতরণ কমে যাওয়ায় আসন্ন বোরো মৌসুমের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, ২০২৪ সালের শেষার্ধে পরপর দুটি বন্যায় ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের কৃষি খাত। এর প্রভাবে শীত মৌসুমের আগে কোনো কোনো সবজির দাম পৌঁছেছিল কেজিতে ১০০ টাকার ওপরে। আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চাষাবাদে বিলম্ব হয়েছে। কোথায়ও পানি জমে থাকায় আবাদ ব্যাহত হয়েছে। ফলে আমনের সার্বিক উৎপাদনেও ধাক্কা লেগেছে। অনেকের বীজতলা নষ্ট হওয়ায় পুনরায় আবাদ করতে হয়েছে। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে কৃষির উপকরণ ও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ফলে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কৃষকের ঋণের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। এর মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় ধান উৎপাদন মৌসুম। কৃষকরা এখন ধানের বীজতলা তৈরি করছেন বেশি। প্রয়োজনের এ মুহূর্তে কৃষিতে ঋণের বিতরণ না বেড়ে উল্টো কমেছে। এ অবস্থায় বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন কমলে দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে যাওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে।

 

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘গত বছর দুটি বন্যা এবং খরাসহ নানা উপদ্রবে কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই বন্যা-উত্তর উৎপাদন বৃদ্ধিতে এবার আরো বেশি করে ঋণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৃষিঋণের প্রতি আন্তরিক না থাকায় ঋণের প্রবাহ কমেছে। এমনিতেই আমনের উৎপাদন কম হয়েছে। কিন্তু আগামীতে বোরোর উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটা আমাদের সবচেয়ে বড় ধানের মৌসুম। তাই কোনোভাবে উৎপাদন কম হলে চালের বাজার আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না, যা মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দিতে পারে।’

 

কৃষির লাভজনক উপখাতগুলোয় মন্দা ভাব থাকার কারণেও ঋণ প্রবাহ কমতে পারে বলে মনে করছেন কৃষি খাতের বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য কৃষি অর্থনীতিবিদ এমএ সাত্তার মন্ডল বলেন, ‘সবজি চাষ, পশুপালন ও মৎস্য চাষের মতো লাভজনক উপখাতগুলোয় আগে থেকেই মন্দা ভাব ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এক ধরনের অনিশ্চয়তাও ছিল। তাছাড়া ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে জামানত দিতে হয়। এ কারণে কৃষকরা এখন ঋণের জন্য এনজিও প্রতিষ্ঠান ও অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপর বেশি নির্ভর করছেন।’

 

এ পাঁচ মাসে ঋণের জন্য কৃষকদের এনজিওগুলোর ওপর নির্ভরতা বেড়েছে সামান্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে গ্রামীণ ব্যাংক এবং বড় ১০টি এনজিও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কৃষি খাতে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হয়েছে ১৭ হাজার ৭৪৬ কোটি ১৩ লাখ টাকার, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেশি। এনজিওগুলো ঋণ বিতরণের প্রভাব ঠিক রাখতে পারলেও পিছিয়ে পড়েছে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো।

 

ব্যাংকাররা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই ব্যাংক খাত থেকে কৃষিতে ঋণ বিতরণ কমেছে। এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে সার্বিক ঋণ প্রবাহ কমে এসেছিল। তখন মানুষ বের হতে পারেনি। আবার ১০-১২টি ব্যাংক কিছুটা সমস্যায় পড়েছিল। তারাও তখন ঋণ দিতে পারেনি। তাই সার্বিক কৃষিঋণ বিতরণে এর প্রভাব পড়েছে। কিন্তু কৃষিঋণের টার্গেট দেয়া থাকায় এটা আমাদের বিতরণ করতেই হবে। আশা করছি অর্থবছরের বাকি সময়ে কৃষিতে ঋণ বিতরণ বাড়বে।’

 

যদিও দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ঋণ পরিশোধের দিক থেকে বরাবরই সেরা পারফরম্যান্স আসে কৃষি খাত থেকে। তবুও এ খাতে ঋণ বিতরণ কমছে। খাতভিত্তিক ঋণ বিতরণের অনুপাতে আদায়ের হারের দিক থেকে কৃষির অবস্থান প্রতি বছরই শীর্ষে থাকে। এবারো এ খাতে ঋণ বিতরণ কমলেও ঋণ আদায় আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত কৃষিতে ঋণ আদায় হয়েছে ১৬ হাজার ৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

 

কৃষিঋণ বিতরণের উপখাতভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত অর্থবছরের তুলনায় এবার মোট কৃষিঋণ বিতরণে শস্য খাতের অবদান গত অর্থবছরের ৪৫ শতাংশ থেকে কিছুটা বেড়ে ৪৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর দারিদ্র্য দূরীকরণে ঋণ বিতরণের অংশ ৬ শতাংশ নেমে এসেছে ৪ শতাংশে। গত বছরের তুলনায় মৎস্য খাতে ১ শতাংশ বাড়লেও পশুপালন ও পোলট্রি খাতের বিতরণ ১ শতাংশ বেড়েছে।

 

মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ঘটে যাওয়া সর্বশেষ বন্যায় আমনের প্রায় দুই লাখ হেক্টর আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। আবার অক্টোবরের শুরুর দিকে শেরপুর ও ময়মনসিংহের আকস্মিক বন্যায় প্রায় এক লাখ হেক্টর আমনের ফসলি জমি ক্ষতির শিকার হয়। সব মিলিয়ে এবার আবাদি এলাকা কমেছে প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর।

 

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর অন্যতম কুমিল্লা। এখানকার মুরাদনগর উপজেলার স্থানীয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পাভেল খান পাপ্পুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলাটিতে এবার ৭ হাজার ৬৪ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু বন্যায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় অনেক জমি আবাদের আওতায় আনা যায়নি। উপজেলায় এবার আমন ধান চাষ হয় ৫ হাজার ৪৬ হেক্টরে। সে অনুযায়ী, লক্ষ্যের তুলনায় প্রায় ২৯ শতাংশ জমিতে ধান লাগানো যায়নি এবার।

 

কৃষি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যায় অনেক এলাকায় চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ায় কৃষিঋণের চাহিদাও কমে থাকতে পারে। এ বিষয়ে সরকারি সংস্থা বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ঋণ প্রবাহ কমায় অবশ্যই উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। কৃষক টাকা না পেলে জমিতে সার দিতে পারবে না। তবে সাম্প্রতিক বন্যায় অনেক নদীপাড়ের মানুষ জমিতে পুনরায় চাষাবাদ করতে পারেনি। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর এলাকায় এমনটা হয়েছে। তাই সেসব কৃষকের আর ঋণ নেয়ার প্রয়োজনও পড়েনি হয়তো।’

 

আবার ব্যাংকের নানা শর্তের কারণেও প্রান্তিক কৃষকরা ঋণের প্রতি আগ্রহী হন না বলে মনে করছেন কৃষি সম্প্রসারণের কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, ‘সময়মতো কৃষিঋণ পেলে নানাভাবে কৃষক সেটা ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা আছে। আবার যে ঋণ দেয়া হয়, সেটিও পর্যাপ্ত নয়। ব্যাংকের নানা শর্তের কারণে প্রান্তিক কৃষক আগ্রহী হন না। ব্যবস্থাপনা সহজ হলে এটা আরো বাড়বে।’

 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘বন্যা-পরবর্তী সময়ে আমরা নানাভাবে কৃষকদের প্রণোদনা দিয়েছি। এতে রবি মৌসুমের ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু ঋণের বিষয়টি চাহিদার ওপরও নির্ভর করে। নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ দিতেই হবে। তবে এখানে কোনো গ্যাপ তৈরি হয়ে থাকলে বিষয়টি আমাদেরকে দেখতে হবে। প্রয়োজনে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

বোরো মৌসুমের আগে কৃষিঋণ বিতরণ কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি