ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ২:২৭:৪২ এএম

ব্যাংক খাতের অবস্থা আসলে কতটা খারাপ

২২ নভেম্বর, ২০২৪ | ৬:০ এএম

ব্যাংক খাতের অবস্থা আসলে কতটা খারাপ

ছবি: সংগ্রহ

ঢাকার একজন আইনজীবী শরীয়াহভিত্তিক একটি ব্যাংক থেকে ডিপিএসের বিপরীতে ঋণ নিয়েছিলেন। সেই টাকা স্থানান্তর করেন ওই শাখাতেই তার মেয়ের অ্যাকাউন্টে। প্রথম দফায় হাজার পঞ্চাশেক তুলতে পারলেও এখন আর টাকা পাচ্ছেন না।

 

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বাসাবোর ওই শাখা থেকে অক্টোবর থেকে মাসে শুধু পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে ওই আইনজীবীকে, ব্যক্তিগত তথ্য বলে যিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি।

 

তিনি বলেন, জরুরি প্রয়োজনে ঋণটা নিতে হয়েছিল। অথচ গত সেপ্টেম্বরের পর সেই অর্থ তুলতেই পারছেন না। এখন মাসের ১৯ থেকে ২৩ তারিখ পাঁচ হাজার টাকার একটা চেক জমা নিচ্ছে ব্যাংক; আর টাকা দিচ্ছে ২৫ তারিখ। একজন গ্রাহককে মাসে শুধু একবারই টাকা দেওয়া হচ্ছে। ব্যবস্থাপকের সঙ্গে দেখা করেও লাভ হয়নি।

 


ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ওই আইনজীবীকে বলেছেন, “আপনারা তো জানেন সবকিছু। সবাই একসঙ্গে টাকা তুলতে আসায় এমনটি হচ্ছে। আমার কিছুই করার নেই।”

 

ঋণের টাকা তুলতে না পারলেও এর বিপরীতে ঠিকই সুদ গুনতে হবে ওই গ্রাহককে। এ নিয়ে ক্ষোভ ও বিরক্তির শেষ নেই তার।

সবশেষ গত সোমবার ১৭ ব্যাংকের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে মূলধন ঘাটতিতে থাকা কোনো ব্যাংক লভ্যাংশ দিতে পারবে না। নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি থাকলে লভ্যাংশ দেওয়ার নিয়ম নেই।

 

ওই বৈঠকে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বলে খবরে এসেছে। ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এর প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। এগুলোর শেয়ারের বিনিয়োগকারীরা পড়েছেন বেকায়দায়।

 

ক্ষমতার পালাবদলের ডামাডোলের মধ্যে ব্যাংক বাঁচানোর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গত তিন মাসে অনেকগুলো ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে নতুন করে গড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীদের সরিয়ে পুরনো অংশীদার বা উদ্যোক্তাদের ব্যাংকের পরিচালনায় ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অনেক স্বতন্ত্র পরিচালকদের।

আগের সরকারের সুবিধাভোগী অনেক ব্যাংক উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। অনেকে বিদেশে পালিয়ে গেছেন, কেউ কেউ আত্মগোপনে রয়েছেন। এমনকি কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যবস্থাপনার শীর্ষস্থানীয় পদে দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ও আত্মগোপন বা পলাতক থাকার খবরও এসেছে; তারা সেই থেকে কর্মস্থলে যাওয়া বন্ধ কর দিয়েছেন।

র আহসান এইচ মনসুরও গত ১১ নভেম্বর রাজধানীতে অর্থনীতির এক অনুষ্ঠানে ব্যাংক খাতের দুরাবস্থার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, “একটি ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা যদি এক পরিবার নিয়ে যায়, তাহলে সেই ব্যাংকের কী থাকে? এসব ক্ষেত্রে নতুন কিছু করতে হবে।”

 

পূবালি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মাদ আলী মনে করেন, ব্যাংকের অবস্থা খারাপ না কি ভালো তা কয়েকটি সূচকের মাধ্যমে যাচাই করা যায়। ব্যাংকের সার্বিক তারল্য অবস্থা কোন অবস্থানে রয়েছে সেটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সূচক।

 

“ব্যাংকটিতে পর্যাপ্ত নগদ টাকার সরবরাহ রয়েছে কি না সেই বিষয় দেখতে হবে। গ্রাহকদের নগদ টাকা দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সিআরআর-এসএলআর মেইনটেইন করতে পারছে কি না সেই বিষয়গুলোর সূচকই বলে দেয় সেই ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে।”

 

আবার ব্যাংকে আমানতের হার ভালো হলে সেই ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো বলেও তিনি মনে করেন। তার মতে, আমানত বাড়লে সেই ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা বেশি থাকে।

তার ভাষ্য, ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ত ও প্রভিশন সঠিকভাবে সংরক্ষণ রাখতে পারার বিষয়টিকে ব্যাংকের অবস্থার ‘প্যারামিটার’ হিসেবে ধরা হয়।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্যাংক খাতের বর্তমান যে অবস্থা তাতে ক্যামেলস রেটিংয়ে খারাপ ব্যাংকের সংখ্যা আরও বাড়বে সামনে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা, যা আগের তিন মাসের তুলনায় আড়াই গুণেরও বেশি। মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা। এটি বিতরণ করা ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। জুন শেষে যা ছিল ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বেশি।

 

মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ। এসব ব্যাংকের তারল্যে প্রভাব পড়ে না কারণ এগুলো রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাংক। তবে এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে ৫০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ এসব ব্যাংকে।”

 

অপরদিকে বেসরকারি ব্যাংকে মোট খেলাপির পরিমাণ ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

 

ব্যাংকাররা বলছেন, ৬০টির অধিক ব্যাংকের মধ্যে হাতে গোনা ১০-১২টি ব্যাংক শক্তিশালী অবস্থানে থাকলেও বেশির ভাগ ব্যাংক হয় খেলাপি ঋণ কিংবা তারল্য সংকটে ভুগছে। আবার চরম মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে কোনো কোনো ব্যাংক।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে- অগ্রণী, জনতা, বেসিক ও রূপালী ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে কৃষি ও রাজশাহী কৃষি ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে মূলধন ঘাটতিতে জর্জরিত।

মূলধন ঘাটতি নিয়ে চলা বেসরকারি ব্যাংকের তালিকাও লম্বা। এগুলোও নিয়ম নীতিকে নানাভাবে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড় নিয়ে মূলধন ঘাটতি পূরণ করা ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা পরিচালনা করছে।


মূলত সরকার পতনের পর ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে এমন ভীতি সঞ্চার হয়েছিল জনমনে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও সাইফুল আলমের (এস আলম) নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম ও টাকা পাচারের কথা তুলে ধরে সেগুলোর দুর্দশার প্রকট চিত্র সামনে আনা হয়। সরকার পতনের শেষ সময়ে এস আলম গ্রুপ ব্যাপক টাকা তোলার চেষ্টাও চালায়।

 

 

তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে এসে মাসে ব্যাংক খাতের বাইরে চলে যাওয়া টাকা কিছুটা ফিরতে শুরু করে। গ্রাহক দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে যেমন টাকা রাখছিলেন, তেমনি নিজের কাছে নগদ টাকা বেশিদিন রাখার ঝুঁকিও নিতে চাইছিলেন না। যেসব কারণে অক্টোবরে সোয়া চার হাজার কোটি টাকা ফেরত এসেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে।

 

 

 

তবে ব্যাংকাররা বলছেন, বাড়তে থাকা আমানতের সুদহার এবং ঋণের হার বাড়তে থাকায় সেগুলোর ব্যবসাও চাপে পড়েছে। আমানত পেতে বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। অথচ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির বিবেচনায় বিনিয়োগ কমায় উদ্যোক্তা ও শিল্প কারখানা থেকে ঋণের চাহিদা কমে গেছে।

 

তার ভাষ্য, এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন মোতাবেক যেসব ব্যাংকে যত রকম সমস্যা রয়েছে তা সমাধান করতে হবে। সরকারের উচিত বাংলাদেশ ব্যাংক যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে সেজন্য তাদের পূর্ণ সহায়তা করা।

 

 

 

 

তিনি বলেন, “আমরা এখন সিমটম দেখে সংস্কারের পদক্ষেপ নিচ্ছি। ম্যানেজমেন্ট খারাপ ছিল, গভর্নেন্স করাপ্ট ছিল। কতগুলো ব্যাংক ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ইসলামী ব্যাংক দেশের বিগেস্ট ব্যাংক, এটা কিন্তু ফিরে আসার পথে। কিছু ব্যাংক হয়ত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে। কিন্তু আমরা কোনো ব্যাংক বন্ধ করে দেব না।

 

“আমরা একটি পায়ের ছাপ রেখে যাব। আমরা এমন জায়গা দিয়ে হাঁটব, যেখানে রাস্তা তৈরির দিক নির্দেশ করবে। আমরা কিছু সংস্কার করে যাব।”

ব্যাংক খাতের অবস্থা আসলে কতটা খারাপ