ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৭:৫৮:৫৪ পিএম

মুক্ত বাণিজ্যের প্রচারক যুক্তরাষ্ট্রই এখন উল্টো পথে হাঁটছে

১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১০:০ পিএম

মুক্ত বাণিজ্যের প্রচারক যুক্তরাষ্ট্রই এখন উল্টো পথে হাঁটছে

ছবি: সংগ্রহ

আমদানিতে শুল্কের আগ্রাসী ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যের এতদিনের নিয়ম-নীতিকে একেবারে উল্টে দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলা যায়, কয়েক দশক ধরে মুক্ত বাণিজ্যের প্রধান প্রচারকের আসনে থাকা যুক্তরাষ্ট্রই রাতারাতি ভোল পাল্টাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প ঘোষিত ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা পারস্পরিক শুল্ক বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং মিত্র ও প্রতিপক্ষ উভয়ের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব বাড়বে। 


রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বলতে এমন ব্যবস্থাকে বোঝাচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বিদেশী পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়াবে, যাতে সেটি অন্য দেশে মার্কিন পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কের সমান হয়।


গত সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘যদি তারা ২৫ শতাংশ শুল্ক নেয়, আমরাও ২৫ শতাংশ নেব। যদি তারা ১০ শতাংশ নেয়, আমরাও ১০ শতাংশ নেব। যদি তারা ২৫ শতাংশের বেশি নেয়, তাহলে আমরাও ঠিক ততটাই নেব।’

 

ষাটের দশক থেকে শুল্ক বা আমদানি কর বিভিন্ন দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ হচ্ছে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রক্রিয়াটি নিজের হাতে নিতে চাইছেন। মার্কিন আইনি পরামর্শক সংস্থা মিলার অ্যান্ড শেভালিয়েরের বাণিজ্যবিষয়ক আইনজীবী রিচার্ড মোজিকার ভাষ্যে, স্পষ্টতই এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পদ্ধতিকে বিঘ্নিত করছে, বাণিজ্য ব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্যের সব জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে।

 

শুল্ক প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ও স্থায়ী বাণিজ্য ঘাটতির দিকে ইঙ্গিত করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৯৭৫ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই বিক্রির তুলনায় বেশি পণ্য কিনছে। ট্রাম্পের দাবি, মার্কিন কোম্পানি বিদেশে অন্যায্য ও অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার শিকার হচ্ছে। এর বড় কারণ হলো অন্য দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর বেশি শুল্ক আরোপ করে আসছে।

 

২০১৭-২১ সালের প্রথম মেয়াদে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে শুল্ক ব্যবহার করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদের তিন সপ্তাহের মধ্যেই চীন থেকে আমদানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। বিদেশী ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন।

 

অর্থনীতিবিদরা বাড়তি শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের মতো আশাবাদী নন। কারণ এতে অতিরিক্ত ব্যয় শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ঘাড়ে চেপে বসে। তবে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফের হুমকি অন্য দেশকে আলোচনার টেবিলে আনতে পারে এবং আমদানি কর কমাতে তাদের উৎসাহিত করতে পারে। জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটাস সেন্টারের ক্রিস্টিন ম্যাকড্যানিয়েল বলেন, ‘এটি উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক হতে পারে। কারণ তাদের পক্ষে এ শুল্ক কমানোই ভালো।’ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মোটরসাইকেল ও বিলাসবহুল গাড়ির ওপর শুল্ক কমিয়েছে ভারত এবং মার্কিন জ্বালানি আমদানি বাড়াতে সম্মত হয়েছে।

 

আইনি সংস্থা অ্যারেন্টফক্স শিফের অংশীদার ও মার্কিন কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশনের সাবেক আইনজীবী এন্তোনিও রিভেরা শুল্ক আরোপ নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ আমদানি আইটেমে মোটরসাইকেল থেকে আম পর্যন্ত হাজার হাজার ট্যারিফ কোড রয়েছে। কীভাবে এত পণ্যে শুল্ক নির্ধারণ হবে এখনো স্পষ্ট নয়। আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও সিইও স্টিফেন লামার বলেন, ‘এটি অত্যন্ত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। এখন ব্যবসার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন কঠিন হয়ে পড়ছে।’

 

সাধারণত মার্কিন শুল্ক হার অন্য দেশের তুলনায় কম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তারা বাণিজ্য বাধা ও শুল্ক কমানোর জন্য চাপ দিয়ে আসছে। কারণ দেশটির নীতিনির্ধারকরা মুক্ত বাণিজ্যকে শান্তি, সমৃদ্ধি ও মার্কিন রফতানির প্রসারের মাধ্যম হিসেবে দেখতেন। ফলে মার্কিন ভোক্তারা কম দামে বিদেশী পণ্য কেনার সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের দাবি, পুরনো মুক্ত বাণিজ্য নীতি মার্কিন কারখানা ও উৎপাদকদের ক্ষতি করেছে। প্রথম মেয়াদে তিনি বিদেশী ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, ওয়াশিং মেশিন, সৌর প্যানেল ও চীনের প্রায় সবকিছুর ওপর শুল্ক আরোপ করেন। ডেমোক্রেটিক জো বাইডেনও সে সুরক্ষা নীতির বেশির ভাগই চালু রেখেছেন।

 

উচ্চ শুল্ক নিয়ে ট্রাম্প অভিযোগ আনলেও এটি কিন্তু গোপনে তৈরি হয়নি। বরং অনেক বছরের আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ হয়েছে, যা উরুগুয়ে রাউন্ড নামে পরিচিত। এ চুক্তি অনুসারে, দেশগুলো নিজেরা শুল্ক হার নির্ধারণ করতে পারে। তবে ‘মোট ফেভার্ড নেশন’ বা এমএফএন নীতির অধীনে একটি দেশের তুলনায় অন্য দেশ থেকে বেশি শুল্ক নেয়া যাবে না। তাই বিদ্যমান উচ্চ শুল্ক শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, বরং সব দেশের জন্যই সমান।

 

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার কিছু উপদেষ্টার দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারে উচ্চ শুল্ক। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনের শুল্ক আরোপের ধারাবাহিকতা সত্ত্বেও গত বছর ঘাটতি ৯১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে পৌঁছে, যা দেশটির ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

 

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাণিজ্য ঘাটতির মূল কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো। মার্কিন ভোক্তারা প্রচুর ব্যয় করে, কিন্তু পর্যাপ্ত সঞ্চয় করে না। এ অতিরিক্ত ব্যয়ের জন্য বিশাল পরিমাণে বিদেশী পণ্য ও পরিষেবার ওপর নির্ভর করতে হয়। ইউসিএলএর অর্থনীতিবিদ কিম্বারলি ক্লাউসিং বলেন, ‘বাণিজ্য ঘাটতি মূলত একটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা। যতক্ষণ না আপনি সঞ্চয় ও কর ব্যবস্থা ঠিক করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এ ঘাটতি চলতে থাকবে।’

মুক্ত বাণিজ্যের প্রচারক যুক্তরাষ্ট্রই এখন উল্টো পথে হাঁটছে