ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৭:২৮:১২ এএম

মৌজা দরে দলিল নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ডিসেম্বরে

২৫ অক্টোবর, ২০২৪ | ১২:০ পিএম

মৌজা দরে দলিল নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ডিসেম্বরে

ছবি: সংগ্রহ

রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে ২০১৪ সালে সাড়ে পাঁচ কাঠা (৩ হাজার ৯৬০ বর্গফুট) জমি বিক্রি করেন কামাল হোসেন (ছদ্মনাম)। তিনি আয়কর নথিতে জমির বিক্রয়মূল্য দেখান ১ কোটি ৯২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু বায়না দলিলে বিক্রয়মূল্য পাওয়া গেছে ৯ কোটি টাকা। একই ব্যক্তি নাভানা রিয়েল এস্টেট থেকে ঢাকার বারিধারা এলাকায় ৪ হাজার ১৪১ বর্গফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাট কেনেন। তিনি আয়কর নথিতে ফ্ল্যাটটির নিবন্ধনমূল্য দেখিয়েছেন ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু নাভানা রিয়েল এস্টেটকে পরিশোধ করেছেন ১০ কোটি ৭৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ এ লেনদেনে তার ৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা অপ্রদর্শিত থেকে গেছে।


রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী কিংবা বারিধারার মতো এ ধরনের বেশির ভাগ কেনাবেচায়ই অপ্রদর্শিত থেকে যাচ্ছে বিপুল অর্থ। মৌজা দরে নিবন্ধন প্রক্রিয়াই ‘বৈধ পথে’ বিপুল পরিমাণ অর্থ অপ্রদর্শিত রাখার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। এতে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করের বোঝা থেকে বাঁচতে মৌজা দরে রেজিস্ট্রেশন করছেন ক্রেতারা। এ সমস্যা সমাধানে বাজারমূল্যে জমি কেনাবেচার পদ্ধতি বের করতে ২০২২ সালে গঠন করা হয় জাতীয় সমন্বয় কমিটি। কিন্তু এখনো সমাধান মেলেনি।

 

মৌজা দর হচ্ছে জমির সর্বনিম্ন মূল্য। সম্পত্তির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা ২০১০ (সংশোধিত ২০১২ ও ২০১৫) অনুযায়ী এ দর নির্ধারণ হয়। বর্তমানে দেশে মৌজা দরে জমি কেনাবেচা ও নিবন্ধন হচ্ছে। দুই বছরের জন্য সর্বশেষ মৌজা দর কার্যকর হয় ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি। সে হিসাবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এর মেয়াদ শেষ হচ্ছে। কিন্তু এবারো নতুন করে দর নির্ধারণে বাজারভিত্তিক মূল্য নিবন্ধন পদ্ধতি বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর গুলশান-বনানীসহ অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট কিনতে গেলে প্রতি বর্গফুটের দাম পড়ে ২০-২৫ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে দুই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের মূল্য দাঁড়াচ্ছে ৪-৫ কোটি টাকা। অথচ নিবন্ধনে অভিজাত এসব ফ্ল্যাটের মূল্য দেখানো হচ্ছে কোটি টাকারও কম।

 

গুলশানে একদিনেই চারটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্য বলছে, বেনজীরের কেনা ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট চারটির দাম দেখানো হয়েছে ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অথচ এসব ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য ছিল ২৫ কোটি টাকার বেশি। পুরো অর্থই পরিশোধ হয় নগদে। এ কেনাবেচনায় ২২ কোটি টাকার বেশি অপ্রদর্শিত থেকে গেছে।

 

বিধিমালা অনুযায়ী, বাজারমূল্য নির্ধারণ করে একটি কমিটি। কমিটির মাধ্যমে দুই বছর পরপর বাজারমূল্য হালনাগাদ হয়। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ে (২২ মাস) দলিলে উল্লেখ করা দামের গড় করে নতুন দর নির্ধারণ হয়। পরে এর ভিত্তিতে মৌজা দর চূড়ান্ত করেন ভূমি নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক। এছাড়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ), গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (গাউক), কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন প্লট, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেসের দর তারা নিজেরা বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দেয়।

 

এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার বলেন, ‘রাজউক দর নির্ধারণ করে না। মন্ত্রণালয় (গৃহায়ন ও গণপূর্ত) নির্ধারণ করে দেয়। আমরা সেটি বাস্তবায়ন করি মাত্র। আমাদের নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়া শতভাগ অটোমেটেড।’

 

ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নির্ধারিত বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে জমি কেনাবেচা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আবাসন খাতসংশ্লিষ্টরাও।

 

এ বিষয়ে দ্বিমত জানিয়েছেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (রিহ্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও ব্রিক ওয়ার্কস লিমিটেডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘আগে হতো, এখন আর হয় না। এখন নিয়ম অনুযায়ী হচ্ছে।’

 

জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের সময় দলিলভেদে স্ট্যাম্প শুল্ক, রেজিস্ট্রেশন ফি, স্থানীয় সরকার কর, উৎসে কর, উৎসে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর ও বিবিধ ফি দিতে হয়। এসব করের চাপ থেকে রেহাই পেতে ক্রেতা-বিক্রেতা কম মূল্য দেখান বলে মনে করেন দুদকের লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন উইংয়ের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম। সাবেক এ জেলা ও দায়রা জজ বলেন, ‘নতুন মৌজা দর নির্ধারণ করা উচিত। দলিলে কখনই সঠিক দর লেখা হয় না। প্রকৃত দর দেখালে কর বেশি দিতে হয়। তাই আমি মনে করি, কর কমানো উচিত। তাহলে সবাই প্রকৃত মূল্য দেখাবে। আর দলিল মূল্য বিশ্লেষণের পরিবর্তে বাজারদর বিশ্লেষণ করেই মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।’

 

বাজারমূল্যে জমি কেনাবেচার বিষয়ে একটি কার্যকর পদ্ধতি বের করার সিদ্ধান্ত নেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০২২ সালে নতুন পদ্ধতি বের করার দায়িত্ব পান আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। তিনি কাজটি করবেন ভূমি মন্ত্রণালয়, নিবন্ধন অধিদপ্তর এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের সমন্বয়ে।

 

এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘রেজিস্ট্রেশন খরচ এমনিতেই বেশি; করও আছে। দুটি মিলিয়ে কীভাবে সহজ করা যায় আমরা সে বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। বাজারমূল্যে জমি কেনাবেচার বিষয়ে একটি কার্যকর পদ্ধতি বের করতে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটি সক্রিয় হলে একটা সমাধান বের হয়ে আসবে।’

 

বাজারভিত্তিক মূল্যে জমি নিবন্ধন পদ্ধতি কার্যকর করতে ২০২২ সালের ৩০ অক্টোবর সাত সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। কমিটি ১ ডিসেম্বরের মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবসহ প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) সচিবের কাছে।

 

জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও রাজস্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে বাজারভিত্তিক জমির নিবন্ধন মূল্য বাস্তবায়নে গঠিত উপকমিটির আহ্বায়ক করা হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) রুখসানা হাসিনকে। উপসচিব (কেন্দ্রীয় ব্যাংক) মো. জেহাদ উদ্দিনকে করা হয় সদস্য সচিব। অন্য সদস্যরা হলেন ভূমি মন্ত্রণালয়, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ, এনবিআর, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও নিবন্ধন অধিদপ্তরের প্রতিনিধি।

 

গঠিত কমিটিকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য-উপাত্ত পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয় নিবন্ধন অধিদপ্তরকে। পাশাপাশি কমিটিকে সার্বিক সহায়তা করবে বিএফআইইউ। এ কমিটি জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও রাজস্ব বাড়াতে বাজারভিত্তিক মূল্যে জমির নিবন্ধন পদ্ধতি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবসহ প্রতিবেদন তৈরি করবে।

 

বাজারভিত্তিক মূল্যে জমির নিবন্ধন পদ্ধতি বাস্তবায়নে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত চারটি বৈঠক করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কিন্তু গত আট বছরে কার্যকর কোনো পদ্ধতি চূড়ান্ত করা যায়নি।

 

জমির প্রকৃত বাজার ও মৌজা দরের তারতম্য দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে জানিয়ে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে একটি চিঠি দিয়েছিল দুদক। এতে বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছিল।

 

এ প্রসঙ্গে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান খান বলেন, ‘মৌজা দরের চেয়ে বেশি দরে বিক্রি এবং সে দরে রেজিস্ট্রেশন না করার সমস্যা আমাদের বহু পুরনো। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই এটা গোপন করছেন। মৌজা দরে রেজিস্ট্রেশন করেন কর ফাঁকি দেয়ার জন্য। এ সুযোগ তারা নিচ্ছেন।’

 

এ বিষয়ে নিবন্ধন অধিদপ্তর বলছে, তারা জমির অবস্থান অনুযায়ী বাজারমূল্য নির্ধারণের পক্ষে। তাদের যুক্তি, বাস্তবতার নিরিখে মূল্য নির্ধারণ করা হলে হস্তান্তর দলিল রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা বাড়বে। সরকারের রাজস্বও বাড়বে। তবে বিষয়টি জটিল ও সময়সাপেক্ষ উল্লেখ করে এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তের কথা বলেছে সংস্থাটি।

 

এ প্রসঙ্গে নিবন্ধন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) উম্মে কুলসুম বলেন, ‘২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির পর আর কোনো অগ্রগতি নেই। চূড়ান্ত হওয়ার জন্য বিষয়টি আইন ও বিচার বিভাগের কাছে রয়েছে।’

মৌজা দরে দলিল নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ডিসেম্বরে