ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৯:৩১:২৯ পিএম

রবি মৌসুমে শস্যবীজ সরবরাহে সংকট দাম ঊর্ধ্বমুখী

২৩ অক্টোবর, ২০২৪ | ৮:৫৮ এএম

রবি মৌসুমে শস্যবীজ সরবরাহে সংকট দাম ঊর্ধ্বমুখী

ছবি: সংগ্রহীত

শীতকালীন উৎপাদন মৌসুম সামনে রেখে বাজারে শস্যবীজের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক দুটি বন্যা ও নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতায় প্রায় সব ধরনের শস্যজাতীয় বীজপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এতে আবাদ কমে যাওয়ার পাশাপাশি আগামী মৌসুমে দেশের সার্বিক উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।


দেশের ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমের শেষে এখন শীতকালীন মৌসুমের মসলাসহ বিভিন্ন শস্যের চাহিদা বেড়েছে। দেশের বাজারে আমদানি সংকটে চাহিদা বৃদ্ধিতে সরবরাহ বিগত সময়ের তুলনায় কম। তাছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচটি জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা, ময়মনসিংহ অঞ্চলের বন্যায় কৃষকের নিজস্ব বীজভাণ্ডার নষ্ট হয়েছে। যার কারণে রবি মৌসুমের শুরুর প্রথম সপ্তাহে প্রায় সব ধরনের শস্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে ধান, সরিষা, ধনিয়া, কালিজিরা, মরিচ, বাদামসহ ডালজাতীয় শস্যবীজের দাম।


পাইকারি পর্যায়ে গতকাল প্রতি কেজি সরিষাবীজ বিক্রি হয়েছে ৯৬-৯৭ টাকা কেজি। ১০ দিন আগেও প্রতি কেজি সরিষাবীজ বিক্রি হয়েছে ৮০-৮২ টাকা কেজিতে। এছাড়া সপ্তাহের ব্যবধানে বাদামের দাম কেজিপ্রতি ৩-৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩৮-১৪০ টাকায়, মরিচ ৩০-৪০ টাকা বেড়ে ১৮০-১৮৫ টাকায়, ধনিয়া প্রায় ৩৫ টাকা বেড়ে ৯৫ টাকায়, কালিজিরা ১৫-২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৬৫ টাকায়। আগাম শস্য রোপণের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি বাজারে বাড়তি চাহিদা তৈরি হওয়ায় বাজারে এসব শস্যের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জের মেসার্স নাজিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপক অমল সাহা বণিক বার্তাকে জানান, দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে কয়েক মাস ধরে বেশকিছু মসলা, ডাল ও বাদামজাতীয় শস্য সরবরাহ কম হয়েছে। তাছাড়া আমদানির পরিমাণও ছিল কম। এ কারণে শীত মৌসুম চলে আসায় শস্যবীজের চাহিদা ও দাম দুটোই বেড়েছে। বীজের মূল্যবৃদ্ধিতে ভোগ্যশস্যের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। তবে রোপণ মৌসুমের শুরুতে দাম বাড়লেও পুরোদমে শীত শুরু হলে বাজার স্থিতিশীল হতে পারে।

রবি মৌসুমে সরিষা, মরিচ, বাদাম, ধনিয়া, হলুদ, ভুট্টা, গম, সয়াবিন, তিল, তিসি, সূর্যমুখী, মসুর, ছোলা, বার্লি, মাষকলাই, মুগ, খেসারি, ফেলন, মটর, অড়হরসহ বিভিন্ন শস্য রোপণ করেন কৃষক। এসব শস্যের অধিকাংশ কৃষক পর্যায়ে বীজ মজুদ থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি চাষ হওয়া শস্যগুলো লেনদেন হয় পাইকারি বাজারে। রবি মৌসুমে সবচেয়ে বেশি সরিষা, ধনিয়া, মরিচজাতীয় শস্য চাষাবাদ হওয়ায় এসব পণ্যের দাম বাড়ছে। উৎপাদন মৌসুমে বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি চাষের পরিমাণ কমার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রবি মৌসুমে দেশে বিভিন্ন শস্য আবাদ হলেও দেশীয় চাহিদার কারণে প্রায় শতভাগ শস্যই আমদানি করতে হয় বিশ্ববাজার থেকে। ভারত থেকেই দেশে সবচেয়ে বেশি শস্য আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। বন্যা, দেশীয় রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ পূজার বন্ধের কারণে আমদানি প্রক্রিয়ায় ধীরগতি থাকায় দেশে সাময়িক সংকট দেখা যাচ্ছে। এজন্য দাম বাড়ছে মসলাপণ্যের। বর্তমানে আমদানি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় সরবরাহ বাড়ছে। এতে বাজার আবারো স্থিতিশীলতায় ফিরতে পারে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রাম কৃষি অঞ্চলের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় এবার অতিবৃষ্টি, বন্যা, পাহাড়ি ঢল ও উপকূলীয় এলাকার ৪৬টি উপজেলায় কৃষকদের মধ্যে বসতবাড়িতে শীতকালীন সবজি উৎপাদনে দুই পর্বে প্রণোদনা ও বীজ সরবরাহ করছে কৃষি বিভাগ। এর মধ্যে বোরো উফশী জাতের সমলয়ে চাষাবাদ ব্লক প্রদর্শনী স্থাপনে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকা, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বোরো বীজের জন্য (উফশী জাতের) ১০ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার, বোরো বীজ ও সারের জন্য ১৫ কোটি ৬ লাখ ৭৫ হাজার এবং বসতবাড়িতে শীতকালীন সবজিবীজ ও নগদ সহায়তায় ১৪ কোটি ১ লাখ ১৬ হাজার টাকা দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের অনুমোদন পেলে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল ছাড়াও দেশব্যাপী রবি মৌসুম সামনে রেখে বোরো ধানসহ শীতকালীন ফসলের বীজ, সার ও কৃষি প্রণোদনা বাড়ানো উচিত বলে মনে করছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

রবি মৌসুম ১৫ অক্টোবর শুরু হয়েছে জানিয়ে কৃষি বিভাগের সূত্র বলছে, বিভিন্ন ফসলের বাজারদর বেশি থাকলে দেশীয় উৎপাদন স্বাভাবিকভাবে বাড়ে। অর্থাৎ কৃষক নিজ উদ্যোগে বাড়তি চাষ ও চাষাধীন জমি পরিচর্যার মাধ্যমে বাড়তি ফসল উত্তোলনের চেষ্টা করে। কিন্তু শস্যবীজের দাম বেশি হলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। কেননা বীজের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে দাম বেশি থাকলেও সরবরাহ সংকট ফসল উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে বেশি মারাত্মক। কারণ বাড়তি দাম সত্ত্বেও কৃষক সময়মতো বীজ না পেলে চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সর্বশেষ দেশীয় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমদানি কম হওয়া, সরবরাহ সংকটে দাম বেড়ে যাওয়ার পর সর্বশেষ বন্যার কারণে কৃষকের নিজস্ব বীজভাণ্ডার বিনষ্ট হওয়ায় চলতি রবি মৌসুমে শীতকালীন ফসল উৎপাদন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে স্বীকার করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচটি জেলায় এ বছর ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। বন্যায় অনেক জেলা-উপজেলায় পানি ঘরের ছাদ পর্যন্ত স্পর্শ করেছে। ফেনীতে বন্যার পানি কয়েক দিন পর্যন্ত ছিল। এতে কৃষকের বীজের মজুদ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা বিষয়টি অধিদপ্তরকে জানিয়েছি। প্রতি বছর রবি মৌসুমে ১২টি ফসলের প্রণোদনা ও বীজসহায়তা দেয়া হয়। এ বছর প্রণোদনা ও বীজ সরবরাহ আগের বছরের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে।’ সময়মতো কৃষক বীজ সরবরাহ না পেলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রবিশস্য উৎপাদন নিয়ে সংশয় দেখা দিতে পারে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি প্রণোদনার ওপর দেশের কৃষক শতভাগ নির্ভর করেন না। কৃষক নিজ উদ্যোগে ভালো মানের বীজ সংগ্রহ করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষক নিজে বীজ সংগ্রহ করেন। দেশের দুটি কৃষি অঞ্চলে বন্যার কারণে এ বছর কৃষকের নিজস্ব বীজ সরবরাহ তুলনামূলক কম থাকবে। তাছাড়া শস্যবীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজার থেকে কম দামে ভোগ্যশস্যের মাধ্যমে চাষাবাদের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ কারণে আগামী মৌসুমে রবিশস্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে বীজ সরবরাহ ও কৃষকদের আগের তুলনায় বাড়তি প্রণোদনা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।

রবি মৌসুমে শস্যবীজ সরবরাহে সংকট দাম ঊর্ধ্বমুখী