ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৭:৩৮:৪৮ এএম

লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহনে খরচ বাড়ছে

২৪ অক্টোবর, ২০২৪ | ১১:২০ এএম

লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহনে খরচ বাড়ছে

ছবি: সংগ্রহ

নৌপরিবহন অধিদপ্তর একটি নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো ফের চালু করায় পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়তে চলেছে। অনেকেই মনে করছেন, এতে সিন্ডিকেটের দাপট বাড়বে।


চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লাইটার জাহাজযোগে পণ্য পরিবহনে ২০২৩ সালে ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো সিরিয়াল প্রথা। এর ফলে বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্য দেশের ৩৪টি নৌরুটে পরিবহনে আগের তুলনায় অন্তত ২০ শতাংশ পণ্য পরিবহন ব্যয় কমে এসেছিল।

 

কিন্তু গত ১৫ অক্টোবর নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরসমূহে পণ্য পরিবহন নীতিমালা, ২০২৪ প্রণয়ন করায় এ ব্যয় আবারও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

 

জাহাজ মালিক, আমদানিকারক ও চট্টগ্রামভিত্তিক একটি জাহাজ মলিক সংগঠন বলছে, এতদিন জাহাজের ভাড়া নির্ধারণ হতো আমদানিকারক ও জাহাজ মালিকদের দরকষাকষির ভিত্তিতে।

 

নতুন নীতিমালা অনুসারে, এখন থেকে লাইটার জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের সমন্বয়ে বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেল -এর অধীনে পরিচালিত হবে।

 

লাইটার জাহাজ বরাদ্দের জন্য লাইটার জাহাজের মালিক, আমদানি-রপ্তানিকারক, পণ্যের এজেন্ট ও লোকাল এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সমন্বয়কারক হিসাবে কাজ করবে ডব্লিউটিসিসি।

 

চট্টগ্রামের লাইটার জাহাজ মালিক প্রতিষ্ঠান এএনজে ট্রেডিংয়ের ম্যানেজিং পার্টনার শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, পণ্য পরিবহন নীতিমালা প্রণীত হলেও পণ্যের ভাড়ার তালিকা নির্ধারণ করা হয়নি। সব ধরনের পণ্যের আমদানিকারক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ভাড়া নির্ধারণ করা উচিত।

 

তিনি বলেন, আগে যখন ডব্লিউটিসি ছিল, তখন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকায় গমবাহী পণ্যের টনপ্রতি ভাড়া ছিল ৬৬২ টাকা। সেল ভেঙে যাওয়ায় এখন আমদানিকারক ও জাহাজ মালিকের পছন্দ এবং দরকষাকষির ভিত্তিতে জাহাজ ভাড়া নির্ধারিত হচ্ছে।

 

'টনপ্রতি ভাড়া কমেছে প্রায় ১৫০ টাকা। এতে আমদানিকারক এবং সাধারণ জাহাজ মালিকরা খুশি। নতুন সেল গঠন করে আবারেও একই সিন্ডিকেটের হাতে পণ্য পরিবহন খাত তুলে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে,' বলেন তিনি।

 

এর আগে ২০১৩ সালে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নিবন্ধিত লাইটার জাহাজযোগে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোতে পণ্য পরিবহন-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। ওই নীতিমালার আলোকে তিনটি লাইটার জাহাজ মালিক সংগঠন—বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) ও ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক)-এর সমন্বয়ে ডব্লিউটিসি গঠন করা হয়।

 

২০২২ সালের ২০ জুন বিচারপতি জেবিএইচ হাসান ও ফাতেমা নাজিব একই ধরনের একটি রিট পিটিশনে ২০১৩ নীতিমালা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। ওই রায়ে ডব্লিউটিসির সব কর্মকাণ্ডের ওপর হাইকোর্টের একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

 

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য লাইটার জাহাজে খালাস করা হয়। এসব পণ্য দেশের ৩৪টি নৌরুটে পরিবহন করে প্রায় ১ হাজার ৫০০ লাইটার জাহাজ।

 

এর মধ্যে ডব্লিউসিটির নিয়ন্ত্রণে ছিল প্রায় ১ হাজার ৩০০টি জাহাজ। এছাড়া বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ৪০০টি জাহাজ বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে যুক্ত ছিল।

 

আইভোয়াকের মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ বলেন, লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহনে মুখ্য ভূমিকা পণ্যের আমদানিকারকদের। এই স্টেকহোল্ডারের কোনো মতামত ছাড়া এভাবে আগের মতো নীতিমালা প্রণয়নের কোনো যৌক্তিকতা নেই।

 

তিনি বলেন, 'শিল্প মালিকদের পণ্য নিজেদের জাহাজে পরিবহনের ক্ষেত্রে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, কারখানার নিজের নামে জাহাজ হতে হবে। বেশিরভাগ শিল্প গ্রুপ নিজেদের বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও মালিকপক্ষের স্বজনদের নামে জাহাজ কিনেছে।

 

'এছাড়া বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি তাদের আমদানি করা পণ্য পরিবহনে জাহাজ চার্টার করে। নতুন এই নীতিমালায় চার্টার করা জাহাজে নয়, নতুন সেলের সিরিয়াল অনুযায়ী ব্যক্তিমালিকানায় থাকা জাহাজ দিয়ে পণ্য পরিবহন করতে হবে। এতে একদিকে যেমন পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়বে, অন্যদিকে সঠিক সময়ে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হবে। পণ্য পরিবহনে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।'

 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডব্লিউটিসি গঠিত হয়েছিল বন্দরের বহির্নোঙর থেকে পণ্য পরিবহন সমন্বয় করতে। কিন্তু তারা নৌরুটে পণ্য পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। এই সেল টনপ্রতি ২০ টাকা কমিশন নিত। নিজেদের ইচ্ছামাফিক জাহাজ বরাদ্দ দিত। পণ্য পরিবহনে বিলম্ব হলে দ্বিগুণ ভাড়া চাপিয়ে দিত। ফলে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যেত দ্বিগুণ।

 

সিমেন্ট ও বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ আমদানিকারক সীকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিরুল হক টিবিএসকে বলেন, ডব্লিউটিসির অধীনে লাইটার জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করত ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট।

 

তিনি বলেন, এখন কোনো সেলের অধীনে জাহাজ চলাচল করছে না। এতে আগের চেয়ে পরিবহন ব্যয় কমে গেছে অন্তত ২০ শতাংশ। কার স্বার্থে আবার সেল গঠন করে পরিবহন ব্যয় বাড়ানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে—এ প্রশ্ন তোলেন তিনি।

 

কোস্টাল শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবির বলেন, সিরিয়াল ছাড়া জাহাজ চালাতে গিয়ে ভাড়া অনেক কমে গেছে। এর ফলে লোকসানে পড়েছে জাহাজ মালিকরা।

 

'ভাড়া না পেয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ৪৫০টি লাইটার জাহাজ স্ক্র্যাপ হিসেবে কেটে ফেলা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগের ডব্লিউটিসি-নির্ধারিত ভাড়ায় পণ্য পরিবহন ছাড়া উপায় দেখছি না,' বলেন তিনি।

 

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের মালিকদের বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য পরিবহনে বাধ্য করার যৌক্তিকতা কতটুকু—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাহাজ পরিচালনা ব্যয় বেড়েছে। নাবিকদের বেতন বেড়েছে। এমন বাস্তবতায় কম নির্ধারিত ভাড়ার কম মুল্যে পণ্য পরিবহন করলে জাহাজ মালিকরা পথে বসে যাবে।

 

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম টিবিএসকে বলেন, 'আগে যারা লাইটার জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রন করতে, তারা এখন নেই। তিনটি জাহাজ মালিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিটিং করে এই নীতিমালা করা হয়েছে।'

 

কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা সিন্ডিকেটকে সুবিধা দিতে আবার একই ধরনের সেল গঠনে শিল্প মালিকদের অভিযোগের বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।

লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহনে খরচ বাড়ছে