ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৭:৫৭:০৯ পিএম

লাল-সবুজ বাতি নিয়ে ফিরছে ট্রাফিক পুলিশ

১ নভেম্বর, ২০২৪ | ৪:০ পিএম

লাল-সবুজ বাতি নিয়ে ফিরছে ট্রাফিক পুলিশ

ছবি: সংগ্রহ

রাজধানী ঢাকার চিরচেনা চিত্র যানজট। ঢাকা শহরে প্রতিদিনই বাড়ছে যানবাহন ও মানুষের সংখ্যা। সে তুলনায় বাড়ছে না সড়ক কিংবা রাস্তার গতিপথ। সড়ক দখল, রাস্তার অব্যবস্থাপনা এবং ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের প্রবণতাকে যানজটের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকার পরিবর্তনের পর রাজধানীতে যানজট পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে যানজট নিরসনে নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুই বিশেষজ্ঞের সহায়তায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আসছে পরিবর্তন। ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণে প্রায় দেড় যুগ আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে ট্রাফিক বিভাগ। সিগন্যালে লাল-সবুজ লাইট স্থাপন করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে হার্ডলাইনে যাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ।

 

চলতি বছর থেকেই ট্রাফিক সিগন্যালে বসছে লাল-সবুজ বাতি। পাশাপাশি সড়কে অব্যবস্থাপনা রোধে ট্রাফিক পুলিশের ইনফোর্সমেন্ট, অবৈধ যানবাহন উচ্ছেদ, দখলমুক্ত ইন্টারসেকশন (সিগন্যাল মোড়), নির্দিষ্ট বাস স্টপেজে যাত্রী ওঠা-নামাসহ বিশেষজ্ঞদের ছয়টি সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। বিশেষ করে বুয়েটের দুই জন বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধায়নে ট্রাফিক পুলিশ, সিটি করপোরেশন ও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সমন্বয়ে যানজট নিরসনে কাজ করছে সরকার। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ডা. হাদিউজ্জামান ও অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন। তাদের দেওয়া ছয়টি সুপারিশের ভিত্তিতেই যানজট নিরসনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার।


ঢাকার যানজট নিরসনে বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সুপারিশগুলো হচ্ছে- এক. মূল সড়ক থেকে অবৈধ রিকশা (ব্যাটারি ও প্যাডেল) সরাতে হবে। দুই. পুলিশের সাধারণ কার্যক্রম ৫ আগস্টের আগে যেমন ছিল, সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করতে হবে। তিন. ছোট যেসব ইন্টারসেকশন (মোড়) আছে, সেখানে সিগন্যালের সময় সর্বোচ্চ দুই মিনিট আর বড় ইন্টারসেকশনে সিগন্যাল সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটের বেশি দেওয়া যাবে না। চার. ছোট ইন্টারসেকশনের ৫০ মিটার ও বড় ইন্টারসেকশনের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনও গাড়ি পার্ক করা, যানবাহন দাঁড়ানো ও যাত্রী ওঠানামা করা যাবে না এবং কোনও ধরনের স্থাপনা থাকা যাবে না।

 

পাঁচ. ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও দুই সিটি করপোরেশন থেকে নির্ধারিত বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করা যাবে না এবং এসব স্টপেজে একটার পাশে আরেকটা বাস দাঁড়ানো যাবে না। ছয়. ঢাকা শহরে ট্রাফিক পুলিশের যে আটটি বিভাগ রয়েছে, এই বিভাগগুলোর প্রতিটিতে একটি করে মোবাইল টিম কাজ করবে। এই মোবাইল টিমে প্রশিক্ষিত একজন ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার, একজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা, ডিটিসিএ ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা থাকবেন। তাদের কাজ হবে ঘুরে ঘুরে সমস্যা দেখা ও সেগুলো সমাধানে কাজ করা।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লাল-সবুজ বাতির মাধ্যমে ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা হলে ট্রাফিক পুলিশ তাদের মূল কাজ করার সময় পাবেন। আসলে সনাতন পদ্ধতিতে সিগন্যাল ছাড়া ও বন্ধ করা ট্রাফিক পুলিশের কাজ না। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং চালক ও পথচারীদের সড়ক বিধি মেনে চলাচলের ওপর জোর দেওয়া তাদের কাজ। অথচ হাত দিয়ে রাস্তায় নেমে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তারা সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করছেন।

 

অধ্যাপক ডা. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘বিগত সময়ে ট্রাফিক সংশ্লিষ্ট সব কাজ হয়েছে প্রকল্প বা প্রজেক্টভিত্তিক। যার ফলে প্রকল্পের টাকা ও সময় ফুরিয়ে গেছে কিন্তু কোনও সমাধান হয়নি। আমরা বলছি এটা কোনও প্রকল্প নয়, এটা হলো সমস্যাভিক্তিক সমাধান। এ ধরনের প্রজেক্টে কোনও খরচ নেই। বলা চলে বিনা খরচে সমস্যা সমাধান করা।’

 

তিনি বলেন, ‘এই কাজে ট্রাফিক পুলিশ, দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সংযুক্ত থাকবেন। তাদের কাজের জন্য আলাদা করে কোনও বরাদ্দ বা খরচ নেই। বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষার্থীর একটি টিম কাজ করছে। তারাও টাকার নয়, দেশের হয়ে সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন।’

 

বুয়েটের মাধ্যমে সিগন্যাল বাতির হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে খরচ কম হবে, আর দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব সিগন্যাল তৈরির জন্য বুয়েট প্রতিটি সিগন্যাল বানানো, ইনস্টল করার জন্য সাড়ে ১০ লাখ টাকা ও মাসে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেড় লাখ টাকা চেয়েছে। এই সিগন্যাল এআইভিত্তিক (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) নয়। এটা সেমি অটোমেটিক করা হয়েছে। এখানে চাইলে সময় নির্ধারণ করা যাবে, যেটি ট্রাফিক পুলিশ রিমোট ব্যবহার করেই করতে পারবে। আবার পিক আওয়ারে পরিবর্তন করা যাবে। যাতে করে সময় উপযোগী হিসাবে ব্যবহার করা যায়।’

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরই মধ্যে পাইলট প্রজেক্টের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। নভেম্বর থেকে সিগন্যাল লাইট স্থাপন করে সড়কে ভিজুয়াল কাজ দেখা যাবে। এরইমধ্যে রাজধানীর অনেক ইন্টারসেকশনে (সিগন্যাল মোড়) ডাইভারশনের মাধ্যমে চার রাস্তার মোড়ের ওপর চাপ কমানো হয়েছে। উচ্ছেদ করা হয়েছে ইন্টারসেকশনের অবৈধ স্থাপনা। আবার অনেক জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কঠোর অবস্থানও দেখা গেছে। অবৈধ যানবাহন ও ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

 

ডিএমপিতে পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য রয়েছে উল্লেখ করে অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান বলেন, ‘এখন আমরা সিগন্যাল ধরার কাজ করছি। একটি ইন্টারসেকশনে চারটি রাস্তার গাড়ি থামাতে চার থেকে আটজন পুলিশ সদস্যকে থাকতে হচ্ছে। সিগন্যালগুলো যখন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে তখন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের মূল কাজ করার সুযোগ বাড়বে। এতে যানবাহনগুলো নিয়মের মধ্যে চলাচল করবে। শুধু দিনে নয়, রাতে সড়ক দুর্ঘটনা রোধেও এটি কাজ করবে। সবাই যখন সিগন্যাল লাইট অনুসরণ করবে তখন রাত-দিন সব সময় এটি কাজ করবে।’ সিগন্যাল বাতি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হবে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

 

ট্রাফিক সিগন্যালে আগে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো দেশের বাইরে থেকে আনা। এগুলোর খরচ অনেক বেশি, আবার নষ্ট হলে সেগুলো ঠিক করতে অনেক অপেক্ষা সময় করতে হচ্ছে। এভাবে সিগন্যালগুলো অকার্যকর হয়ে গেছে। বুয়েটে তৈরি করার ফলে একদিকে খরচ অনেক কমছে, অন্যদিকে নষ্ট হলে দ্রুত ঠিক করা যাবে বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা।

 

ঢাকার গণপরিবহনের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর হলো মেট্রোরেল। তবে এটি সুদূরপ্রসারী প্রকল্প। একটি মেট্রোরেল হয়েছে, আরও দুটি ২০২৭ সালের মধ্যে হওয়ার কথা। বাকি সব জায়গায় বাস চলাচল করে। এ জন্য বাস রুটকে ঢেলে সাজানোর কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘সরকারকে একটি কোম্পানি গঠন করতে হবে। ঢাকা শহরে এই কোম্পানির বাইরে কোনও বাস চলতে পারবে না। এখন বেসরকারি যেসব বাস রয়েছে, তারা হয় এই কোম্পানির কাছে বাস দিয়ে অংশীজন হবে, নয়তো কোম্পানির কাছে বাস বিক্রি করে দেবে। প্রাথমিকভাবে এসব বাস উন্নত করা হবে। এই কোম্পানির আওতায় চলা সব বাসের মান হবে মেট্রোরেলের বগির মতো। যখন সবাই দেখবে নিজের যানবাহনের চেয়ে বাস আরামদায়ক ও দ্রুত যাওয়া যাচ্ছে, তখন সবাই অন্য গাড়ি রেখে বাসে চলাচল করতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করবে।’

লাল-সবুজ বাতি নিয়ে ফিরছে ট্রাফিক পুলিশ