ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৭:০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
শিডিউল বিপর্যয়ে শতকোটি টাকা লোকসানের শঙ্কা
১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৭:০ পিএম
![শিডিউল বিপর্যয়ে শতকোটি টাকা লোকসানের শঙ্কা](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2025/02/10/20250210144704_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
দেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই পরিচালিত হয় প্রধান সামুদ্রিক গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। সম্প্রতি এই বন্দর-সংশ্লিষ্ট প্রাইম মুভার চালক ও মালিকদের ধর্মঘট এবং কর্মবিরতির কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। কর্মবিরতির কারণে ৫ হাজার কনটেইনারের শিডিউল বিপর্যয় হয়। আর সময়মতো আমদানি পণ্যের ডেলিভারি না হওয়ায় বন্দরের ইয়ার্ডে জমে গেছে অতিরিক্ত আরও ৫ হাজার কনটেইনার।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরের কনটেইনার পরিবহনে এ ধরনের অচলাবস্থা তাদের বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলে। এতে একদিকে রপ্তানি পণ্যের শিডিউল বিপর্যয় দেখা দেয়, অন্যদিকে জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইমসহ স্টোর রেন্টের চাপ বাড়ে। তাদের শঙ্কা, বারবার পরিস্থিতি এমন হলে বাংলাদেশে আসতে চাইবে না বিদেশি জাহাজ, যা ক্ষত তৈরি করবে অর্থনীতিতে।
এমন পরিস্থিতিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর কিংবা দেশের অর্থনীতিকে জিম্মি করে কোনো কর্মসূচি না দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গাড়ি পার্কিং করা নিয়ে ডিসি পার্কের গার্ড ও পণ্য পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এর পরই ধর্মঘটের ডাক দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রাইম মুভার অ্যান্ড ট্রেইলার ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। শ্রমিকদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করা, আহতদের চিকিৎসা ও যথাযথ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, ডিসি পার্কে প্রবেশের বিকল্প পথের ব্যবস্থা করা এবং সড়কে শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদান—এই চার দাবিতে সব ধরনের পণ্যবাহী গাড়ি বন্দরে প্রবেশ ও বের হওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহারও হয়। তবে পরদিন ডিসি পার্ক খোলা হলে ফের ধর্মঘটে যান শ্রমিকরা। তারা বলছেন, ডিসি পার্কে সংঘর্ষের ঘটনায় বুধবার সীতাকুণ্ড থানায় মামলা হয়েছে। এতে গাড়িচালক-সহযোগীরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন। এ অবস্থায় তারা গাড়ি চালাতে রাজি নন। তিন দিন পর শুক্রবার রাত ৮টার দিকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে কাজে ফেরেন শ্রমিকরা।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানা থেকে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানির জন্য প্রথমে চট্টগ্রামের ১৯টি বেসরকারি ডিপোতে আনা হয়। ডিপোতে কনটেইনার বোঝাই করে সেগুলো শিডিউল অনুযায়ী জাহাজে তোলা হয়। চট্টগ্রামের বেসরকারি কনটেইনার ডিপো থেকে প্রতিদিন ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ রপ্তানি কনটেইনার জাহাজীকরণের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়া হয়। কনটেইনারগুলো জাহাজে তুলে সিঙ্গাপুর, কলম্বোসহ বিভিন্ন ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ইউরোপ আমেরিকায় পৌঁছায়। কিন্তু তিন দিন পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় ডিপো থেকে ৫ হাজারের বেশি রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে যেতে পারেনি। এতে ডিপোতে তৈরি হয়েছে কনটেইনারের জট।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বন্দরের ভেতর-বাইরে ডেলিভারি হয়নি, শিপমেন্ট যায়নি। যেগুলো বন্দরের ভেতর ছিল, সেগুলোর কাজ চলমান ছিল। প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার কনটেইনার ডেলিভারি হতো, সেগুলো হয়নি। রপ্তানির শিপমেন্টও ডিপো থেকে আসতে পারেনি। সবমিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যেটা আমাদের কেটে উঠতে আরও দুই থেকে চার দিন সময় লাগবে। শ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে বন্দরে কী পরিমাণে লোকসান হয়েছে, তার হিসাব এই মুহূর্তে বলা ডিফিকাল্ট। তবে লোকসানের কথা বলতে গেলে হিসাব করতে হবে, একটি জাহাজ যদি একদিন অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে জাহাজটির প্রায় ১৫ হাজার ডলার ক্ষতি হয়। সার্বিকভাবে দেশের ক্ষতি রয়েছেই। দুই দিনে হয়তো আমাদের ৬-৭ হাজার কনটেইনার ডেলিভারি হতো।’
ডিপো মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল আমিন সিকদার বলেন, টানা তিন দিন পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকার ঘটনা নজিরবিহীন। এতে রপ্তানি পণ্য তিন দিন বন্দরে পাঠানো যায়নি। ১৯টি ডিপোতে স্বাভাবিক সময়ে আট হাজার রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার থাকে। শুক্রবার রাত ৮টায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের সময় এই সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ হাজার। ধর্মঘটের কারণে কনটেইনার জাহাজে না ওঠাতে পারায় যে শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে, তা স্বাভাবিক হতে আরও অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হক বলেন, পরিবহন ধর্মঘটের কারণে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। একটি জাহাজ জেটিতে প্রবেশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমদানি কনটেইনার নামিয়ে রপ্তানি কনটেইনার বোঝাই করে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করে। চলমান সংকটে অতিরিক্ত একদিন অপেক্ষা করেও বুকিং থাকা রপ্তানি পণ্যবাহী এবং খালি কনটেইনার বোঝাই করা সম্ভব হয়নি। একদিন অতিরিক্ত সময় লাগায় বাড়তি চার্জই শুধু নয়, বন্দরে জাহাজের জট তৈরি হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাইম মুভার ও ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়ের বলেন, ‘আমরাও পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে কোনো কর্মসূচি দেওয়ার পক্ষপাতী নই। প্রশাসন কিংবা মালিকপক্ষকে দাবির বিষয়ে বারবার অবহিত করার পরও যখন আমাদের দাবিগুলোকে অগ্রাহ্য করা হয়, তখন বাধ্য হয়ে আমরা এ ধরনের কর্মসূচি দিই। প্রশাসন চাইলে শ্রমিকদের ওপর হামলার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারত।’
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) পরিচালক ফজলুল ইমরান খান বলেন, ‘বন্দর ঘিরে প্রতিদিনই আমাদের অনেক ধরনের মুভমেন্ট হচ্ছে। আমাদের শ্রমিকরা যাচ্ছে, কাঁচামাল যাচ্ছে, খালাস হচ্ছে, ফিনিশ প্রোডাক্ট যাচ্ছে। সুতরাং এই মুভমেন্টে যখনই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে, তখন সবথেকে বড় সমস্যা সৃষ্টি হয় এ খাত ঘিরে। এই তিন দিনের শ্রমিকদের কর্মবিরতি ঘিরে কী পরিমাণ লোকসান হয়েছে সে বিষয় নিয়ে আমাদের সংস্থা কাজ করছে। তবে অবশ্যই একটা বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হতে পারে। সেটার পরিমাণ শতকোটি ছাড়াতে পারে। কিংবা কমবেশি হবে।’
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সদস্য মাহাবুব রানা বলেন, বর্তমানে দেশে কোনো নির্বাচিত সরকার নেই, নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। ডিসি পার্কের একটা ঘটনা নিয়ে পাঁচ-ছয় দিন ট্রাক-লরি বন্ধ রেখে এভাবে আমদানি-রপ্তানি কিংবা ব্যবসা-বণিজ্য বন্ধ রাখা যায় না। এটার দায়িত্ব নিয়ে কেউ সমাধান করছে না। দায়িত্ব নেবেন রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই। যারা দেশ চালাচ্ছেন, তারা ওই রকম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নন। দেশের নির্বাচিত সরকার-জনপ্রতিনিধি থাকলে এই ছোট্ট সমস্যাটা এতদিন থাকত না। আউটারে যেই বিদেশি মাদার ভ্যাসেলগুলো আসে, তাদের প্রতিদিন ১০ হাজার ডলার দিতে হয়। তারপর দিতে হয় ২০ হাজার ডলার। সে কারণে বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিদেশি জাহাজগুলো আর বাংলাদেশে আসতে চাইবে না। তখন আমাদের ভাড়া দ্বিগুণ হবে। বেড়ে যাবে নিত্যপণ্যসহ সব জিনিসপত্রের দাম। এ ঘটনার প্রভাব অবশ্যই কমপক্ষে
১০-১৫ দিন পর থেকে পড়া শুরু করবে। কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হবে, যা স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ জনগণের ওপর বর্তাবে।’
এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়েব) সভাপতি ও প্রিমিয়ার সিমেন্ট এবং সি কম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিরুল হক বলেন, ‘গত ছয় মাস ধরে আমরা দেখলাম, সমস্ত কেউ আন্দোলন করার জন্য রাস্তাকে দখল করেন। আইনের শাসন কোনো দেশে থাকলে এটা সম্ভব নয়। কারণ আপনার অধিকার নেই আরেকজনের রাস্তায় বসার। সরকারের উচিত এসব কিছু কঠোর হস্তে দমন করা। সব দাবি ন্যায়সংগত হতে পারে; কিন্তু এ দাবি আদায়ের সমাধান কেবল রাস্তা নয়। আমরা কোন গণতন্ত্র থেকে কোন গণতন্ত্রে ফেরত যাচ্ছি ভাবতে হবে। এটা কোনো সভ্য দেশের নিয়ম হতেই পারে না।
কারণ পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করলেই অর্থনীতি গতি হারাবে। সব ক্ষেত্রে দাম দিতে হবে অর্থনীতিকে। এভাবে যদি বিচ্ছিন্নভাবে হরতাল, আন্দোলন করতেই থাকি, তাহলে বিগত দিন থেকে আমরা ভালো কোন দিকে যাচ্ছি? সুতরাং আমাদের ভালোর দিকে যেতে হবে। আমরা ভালো করার জন্যই তো এত কিছু করছি। এত ছাত্রজনতার বিপ্লব কেন হলো, সে বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। অর্থনীতিতে এসব বিষয় গভীরভাবে রেখাপাত করবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, এ সমস্যা মূলত বন্দরের সঙ্গে ছিল না। তাদের মনোমালিন্য হয়েছে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে। কিন্তু তারা আন্দোলন করতে বেছে নিয়েছে বন্দরকে। এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। আমরা চাই এক ঘণ্টার জন্যও বন্ধ না থাকুক। সেজন্য আমরা যা যা করণীয় সবটুকু করেছি। যাতে মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব না হয়, সেজন্য আমরা সবসময় চেষ্টা করি নিরসনের জন্য। তবে আমাদের আহ্বান থাকবে, বন্দর কিংবা দেশের অর্থনীতিকে জিম্মি করে কেউ যেন কোনো রকম কর্মসূচি না নেয়।
দাবি-দাওয়া নিষ্পত্তির অনেক উপায় রয়েছে।
![শিডিউল বিপর্যয়ে শতকোটি টাকা লোকসানের শঙ্কা](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)