ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৩:৫৬:৪৪ পিএম

সংকটেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎনিয়ে উন্নয়ন ফ্যান্টাসি

২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ১:০ এএম

সংকটেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎনিয়ে উন্নয়ন ফ্যান্টাসি

ছবি: সংগ্রহ

গ্যাস সংকটে দেশের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার তিন ভাগের দুই ভাগই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বসিয়ে রেখে বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর জন্য দিতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ। গ্যাস সংকটে সরকারি কেন্দ্রগুলোতেও বেতন-ভাতা এবং পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে প্রচুর অর্থ গচ্চা যাচ্ছে। এরপরও নতুন নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। পাইপলাইনে রয়েছে আরও কয়েকটি কেন্দ্র।

 

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির মাধ্যমে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা নেয়া হলেও তা গুড়েবালি। ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ দামের কারণে পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানি সম্ভব হচ্ছে। ফলে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় বোঝা বাড়াচ্ছে গ্যাসভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে সাত-আট বছর আগে এসব কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়ার সময় গ্যাস সংকটের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। উন্নয়ন ফ্যান্টাসিতে আক্রান্ত তৎকালীন হাসিনা সরকার এসব কেন্দ্রের অনুমোদন দেয়।

 

পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, দেশে গ্যাস সংকট ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে দৈনিক সরবরাহ করা হয় ২৫০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। এতে আবাসিক ও শিল্পের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনেও পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। সরবরাহকৃত গ্যাসের মধ্যে ৫০ থেকে ১০০ কোটি ঘনফুট আসে এলএনজি থেকে। বাকিটা দেশের অভ্যন্তরীণ কূপগুলো থেকে উত্তোলন করা হয়। সংকটের কারণে বিদ্যুৎ খাতে চাহিদার অর্ধেক গ্যাসও সরবরাহ করা যায় না।

 

বর্তমানে দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৫৯টি। এগুলোর সক্ষমতা ১২ হাজার ৩৯৫ মেগাওয়াট। এগুলো পুরো সক্ষমতায় চালাতে দৈনিক গ্যাস দরকার ২৭০ কোটি ঘনফুট। গত ৩০ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ওইদিন গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে সর্বোচ্চ চার হাজার ৬৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল। আর বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহ করা হয় মাত্র ১২৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস, যা চাহিদার অর্ধেকের চেয়ে কম। যদিও গত ১৯ ডিসেম্বর গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে সর্বোচ্চ তিন হাজার ৫৩২ মেগাওয়াট। সেদিন গ্যাস সরবরাহ করা হয় ৮৯ কোটি ঘনফুট। গ্যাস সংকট ছাড়াও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেশ কয়েকটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।

 

বর্তমানে সর্ববৃহৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র জাপানের জেরা মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড। গ্যাস সংকটে ৭১৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রটির সক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন করছে। ১৯ ডিসেম্বর এটি গড়ে ৪০০ মেগাওয়াটের চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। দ্বিতীয় বৃহৎ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইউনিট মেঘনাঘাট পাওয়ার প্লান্টও গ্যাস সংকটে চলেছে সক্ষমতার অর্ধেক। ৫৮৪ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি গড়ে ৩০০ মেগাওয়াটের কম উৎপাদন করেছে। তৃতীয় বৃহৎ সামিট মেঘনাঘাট ৫৮৩ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি ১৯ ডিসেম্বর পুরোপুরি বন্ধ ছিল।

 

এদিকে পাইপলাইনে আরও পাঁচটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা দুই হাজার ৩৭৫ মেগাওয়াট। এলএনজি আমদানি করে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর পরিকল্পনা নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে ২০২১ সালের শুরু থেকে এলএনজি আমদানিতে ভাটা পড়ে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি অনেকখানি কমিয়ে দেয় তৎকালীন হাসিনা সরকার। পরে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে ডলার সংকট চরম আকার ধারণ করায় এলএনজি আমদানিতে গতি আসেনি।

 

যদিও চলতি বছরের শুরুর দিকে এলএনজির দাম অনেকটাই কমে গিয়েছিল। তবে গত ছয় মাস ধরে বিশ্ববাজারে এর দাম ঊর্ধ্বমুখী। চাহিদামতো এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়। এতে বসে থাকা বেসরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গচ্চা মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ। যদিও শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কমায় এ খাতে গ্যাসের চাহিদা অনেকখানি কমে গেছে। তবে আগামী গ্রীষ্মে গ্যাস সংকট সৃষ্টি হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতি হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

সূত্র জানায়, পাইপলাইনে থাকা পাঁচটি কেন্দ্রের মধ্যে খুলনার রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। কিন্তু গ্যাস সংকটে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন পেছাতে হচ্ছে আরও ২ বছর। ২০১৮ সালে খুলনার খালিশপুরে রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ শুরু হয়। নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির অধীনে প্রকল্পটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা। পরে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ে। কিন্তু গ্যাসের অভাবে বাণিজ্যিক উৎপাদন পিছিয়েছে ২০২৭ সাল পর্যন্ত।

 

৪০০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিটের উৎপাদন ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে শুরুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘রূপসা ৮০০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভোলা থেকে গ্যাস আনা যায় কি না দেখা হচ্ছে। সেটা পরিকল্পনাধীন, তবে বিকল্প চিন্তাও করা হচ্ছে। সেটা হলো অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস এনে এখানে কাজে লাগানো যায় কি না। আমাদের নতুন করে মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে। সেটা করতেও দুই-তিন বছর লাগবে।’

 

গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছর গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল তিন টাকা ৪৯ পয়সা, যেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গড় জ্বালানি ব্যয় ছয় টাকা ৬৯ পয়সা। আদানির কেন্দ্রে তা আরও বেশি সাত টাকা ৫৭ পয়সা। আর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোর গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল ১৭ টাকা ৩১ পয়সা এবং ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোর গড় জ্বালানি ব্যয় ২২ টাকা ২৪ পয়সা।

 

পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়ছে। এতে শুধু এলএনজি আমদানি করে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে গড় জ্বালানি খরচ পড়বে ফার্নেস অয়েলের কাছাকাছি। অর্থাৎ উচ্চ ব্যয়ের কারণে সরকার চাইলেও বিদ্যুৎ খাতে এখনই গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে পারছে না। এতে গ্যাসের অভাবে পাইপলাইনে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

 

রূপসা ছাড়াও পাইপলাইনে রয়েছে পিডিবির ঘোড়াশাল চতুর্থ ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্প। ৪০৯ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটির ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ। আগামী জুনে এটি উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। আর ঘোড়াশাল চতুর্থ ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্পের উৎপাদন সক্ষমতা ১৫৬ মেগাওয়াট। ৯৭ শতাংশ কাজ শেষ হলেও গ্যাস সংকটে এটি চালু করা যাচ্ছে না। ২০২৬ সালের জুনে এটি চালুর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

 

ময়মনসিংহে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিসিএল) ৪২০ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল (গ্যাস/ডিজেল) বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ ৫৯ শতাংশ শেষ হয়েছে। গ্যাস না পেলে ডিজেলে চালালে এর জ্বালানি ব্যয় পড়বে গ্যাসের ছয়গুণ। এছাড়া আনোয়ারায় ইউনাইটেড গ্রুপ নির্মাণ করছে ৫৯০ মেগাওয়াটের গ্যাসচালিত আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি মূলত আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে চালানোর কথা ছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২৭ সালে চালুর কথা রয়েছে।

 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম বলেন, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে আগ্রহ এবং কর্মযজ্ঞ আওয়ামী লীগ সরকার চালিয়েছে, গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে সেই কর্মযজ্ঞ চালায়নি। এর একটা কারণ হতে পারে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যারা নিয়োজিত থাকে সেখানে অর্থের জোগান এবং অর্থের দেনা-পাওনার ব্যাপার আছে। গ্যাসের ক্ষেত্রে ততটা ব্যক্তিগত লাভ ছিল না। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে উৎসাহটা বেশি ছিল। এর বোঝাটা এখন গ্রাহককে নিতে হচ্ছে। একদিকে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ গ্রাহক পাচ্ছে না। অন্যদিকে বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে সরকারের বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা যাচ্ছে।’

সংকটেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎনিয়ে উন্নয়ন ফ্যান্টাসি