গত ১৫ বছরের অনিয়ম-দুর্নীতি তিন থেকে চার মাসে স্বাভাবিক করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল না হলে অন্য সূচকগুলোও স্থিতিশীল হয় না। তবে ক্ষয় হয়ে যেতে শুরু করা অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করেছে এবং আরও ক্ষয় হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র: অনিয়ম ব্যয় বৃদ্ধির নতুন রেকর্ড

গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারি খাতের পূর্বাভাস : প্রত্যাশা ও অগ্রাধিকার’ শীর্ষক বাণিজ্য সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন।

বাণিজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ। এ সময় নির্ধারিত আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতি আবদুল হাই সরকার, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ রহমান, ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী ও বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।

অর্থনীতি স্থিতিশীল হওয়ার ইঙ্গিত জানিয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো ইতিবাচক সাড়া দিতে শুরু করেছে। গত মাসে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সভায় যোগ দিয়ে সবার কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়েছি। সরকারের বাজেট সহায়তা নয়; বরং বেসরকারি খাতই পাবে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমরা এমন পদচিহ্ন রেখে যেতে চাই, যাতে পরের সরকার এসে তা অনুসরণ করতে পারে। এটুকু বলা যায়, ভবিষ্যতে কেউ অর্থ পাচার করতে পারবে না। আর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ যেন না কমে সেদিকে নজর দিচ্ছে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর প্রশাসন ও কর সংগ্রহের জায়গাটা আলাদা করার কাজ চলছে বলেও জানান অর্থ উপদেষ্টা।

স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী বছরের শুরুতেই নীতি সুদহার এবং সুদহার ক্রমান্বয়ে কমানোর পাশাপশি সরকারি ব্যয় হ্রাস, বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, পণ্য ব্যবস্থাপনায় চাঁদাবাজি রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মার্কিন ডলারে বিনিময় হার বাজারে বিদ্যমান হারের কাছাকাছি রাখার ওপর জোরারোপ করে তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণের মাধ্যমে বিশেষ করে এসএমইদের ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসা প্রক্রিয়া সহজতরের লক্ষ্যে সামগ্রিক শুল্ক ব্যবস্থার সংস্কারের পাশাপাশি ব্যবসা নিবন্ধন ও নবায়ন প্রক্রিয়ায় অটোমেশনের দাবি জানান ঢাকা চেম্বার সভাপতি। পণ্য উৎপাদান অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে শিল্প-কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর জোরারোপ করেন আশরাফ আহমেদ। 

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের সমন্বয় আবশ্যক এবং বিদ্যমান অবস্থার দ্রুত উন্নতি হবে। একই পণ্যের একাধিক বাণিজ্য সংগঠন আছে। এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের বাণিজ্য সম্প্রসারণে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, কবে নাগাদ গ্র্যাজুয়েশন করা যৌক্তিক হবে সে বিষয়ে আরও ডায়লগ করার ওপর তিনি জোর দেন। কেননা এলডিসি-পরবর্তী সময়ে আমরা বেশ কিছু অগ্রাধিকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হব, পাশাপাশি সহায়ক নীতিমালার কোনো বিকল্প নেই বলে মত জ্ঞাপন করেন। নিজেদের বাণিজ্যের উদারীকরণের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের সাব-সেক্টরগুলোর জন্য সহায়ক নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, শিল্প-কারখানায় অস্থিরতা কোনোভাবেই কাম্য নয়, তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন সুনির্দিষ্ট সময়সীমাসহ রোডম্যাপ থাকতে হবে।

আবদুল মোক্তাদির জানান, বিভিন্ন পণ্যের উচ্চ আমদানি শুল্ক হারের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এবং ছোট ব্যবসায়ীরা কঠিন পরিস্থিতি পার করছে। তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, তাই কয়লার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিলেই শিল্প খাতে আরও বেশি হারে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে।

আহসান খান চৌধুরী বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হলে ব্যবসার উন্নয়ন আসবে। ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনের নিরিখে এলসি খুলতে না পারলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান দুটোই ব্যাহত হবে। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি তিনি পার্শিয়াল বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব করেন। এ ছাড়া তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ঋণের সুদের হার হ্রাস প্রদান করা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন।

সেলিম আরএফ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়নি, তবে দ্রুতই এটি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। অর্থনৈতিক খাতে সরকার বেশ ভালো করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিই যথেষ্ট নয়, বরং পণ্যের সাপ্লাই চেইনে চাঁদাবাজি বন্ধসহ বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক খাতের মামলাজট নিরসনে তিনি আরও বেশি হারে আদালত ও বিচারপতি নিয়োগের আহ্বান জানান।

জাভেদ আখতার বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা, ধারাবাহিকতা ও সক্ষমতা একান্ত অপরিহার্য। এলডিসি উত্তরণের বিষয়ে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানান।

আবদুল হাই সরকার বলেন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি উল্লেখ করে বলেন, দেশকে স্বাভাবিক পর্যায়ের নিয়ে আসতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তিনি জানান, জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত ছাড়া শিল্প উন্নয়ন সম্ভব নয়, এ অবস্থার উন্নয়ন জরুরি।

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। আগামী ২০২৬ সালে আমাদের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন স্থগিত করতে হবে, কারণ আমরা এখন বেঁচে থাকার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি। তা ছাড়া এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল বেশ কয়েকটি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে। তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের আমদানি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, পাশাপাশি কমেছে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সংযোজন। আলোচনায় ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান রোমো রউফ চৌধুরী, ডিসিসিআইর প্রাক্তন সভাপতি হোসেন খালেদ, রিজওয়ান রাহমান অংশগ্রহণ করেন। বক্তারা ব্যবসায়ীদের হয়রানি রোধ, ভোটের স্বার্থে পকেট অ্যাসোসিয়েশন তৈরি বন্ধ করা এবং হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়ানোর ওপর জোরারোপ করেন।