ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৭:৩০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
অন্য দেশ বাতিল করলেও আদানির বিতর্কিত চুক্তি নিয়ে নত অবস্থানে অন্তর্বর্তী সরকার
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৭:৩০ পিএম
![অন্য দেশ বাতিল করলেও আদানির বিতর্কিত চুক্তি নিয়ে নত অবস্থানে অন্তর্বর্তী সরকার](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2025/02/13/20250213152440_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
ভারতীয় ধনকুবের আদানি গ্রুপের চেয়ারপারসন গৌতম আদানি ও তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে গত বছরের নভেম্বরে ঘুস ও প্রতারণার অভিযোগ তোলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ফেডারেল কৌঁসুলিরা। এর পরপরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা চালাতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যায় গ্রুপটি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বন্ড বিক্রির পরিকল্পনা বাতিলে বাধ্য হয় আদানি গ্রুপ। বিমানবন্দর ও বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণের চুক্তি বাতিল হয় কেনিয়ায়। আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ পুনর্মূল্যায়ন করা হয় শ্রীলংকায়। এদিক থেকে বিপরীত চিত্র শুধু বাংলাদেশেই। এখনো আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত বিতর্কিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি বাতিল বা সংশোধনের মতো দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং আদানিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর জন্য চিঠি দিয়েছে সরকার। আদানির এ বিতর্কিত চুক্তির বিরুদ্ধে এখনো কঠোর কোনো অবস্থান নিতে না পারাকে সরকারের এক প্রকার নতজানু নীতির প্রয়োগ হিসেবে দেখছেন বিদ্যুৎ খাতের পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা।
খুব শিগগির সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর উপদেষ্টামণ্ডলীর প্রথম সদস্য হিসেবে ভারত সফরে গিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। দেশটিতে গতকাল শুরু হওয়া এনার্জি উইক সম্মেলনে অংশ নিতে এখন সেখানে অবস্থান করছেন তিনি। সম্মেলনের গতকাল ও আজকের অধিবেশনে যোগ দিয়ে তা শেষ হওয়ার আগেই দেশে ফেরার কথা রয়েছে তার। এ সফরে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে কোনো আলোচনার সম্ভাবনা নেই বলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং আদানি গ্রুপসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি সই করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলারে নির্মিত ওই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২৫ বছর কিনবে বাংলাদেশ। আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিলে। দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় একই বছরের জুনে। রয়টার্সের এক হিসাব অনুযায়ী, দেশে ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের গড় দামের চেয়ে প্রায় ৫৫ শতাংশ বেশি মূল্যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বিপিডিবির তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের এপ্রিলে চালু হওয়ার পর থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত আদানি পাওয়ারের কাছ থেকে ১৪ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে জুন সময়ে ২ হাজার ২৪১ কোটি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২ হাজার ১৪৭ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। গত বছরের জুন শেষে বিপিডিবির কাছে আদানি পাওয়ারের বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। অবশ্য এর পরের মাসগুলোয় গ্রুপটির বকেয়া পাওনার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে বিপিডিবির কাছে আদানি গ্রুপের পাওনা রয়েছে ৭৭ কোটি ডলার। পাঁচ মাস ধরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আদানিকে প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৮ কোটি ডলার পরিশোধ করছে। এ সময় আদানির কাছ থেকে গড়ে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে, অর্থ পরিশোধ হয়েছে তার চেয়ে বেশি। মূলত বকেয়ার পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্যই এ নীতি অনুসরণ করছে সরকার। পুরো বকেয়া পরিশোধ করা না হলেও নিয়মিত অর্থ পরিশোধের কারণে আদানি গ্রুপও এখন কিছুটা সন্তুষ্ট বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘আদানির সঙ্গে দেনা-পাওনা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি ছিল, সেটি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তাদের যে পরিমাণ পাওনা রয়েছে, সেটি আমরা রাতারাতি পরিশোধ করতে পারব না। পর্যায়ক্রমে এটি পরিশোধ করার কথা আমরা বলেছি এবং সেই হিসেবে আমরা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করে যাচ্ছি। শীতের কারণে আমাদের চাহিদা না থাকায় এতদিন একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ নেয়া হয়েছে। এখন চাহিদা বাড়ার কারণে আরেকটি ইউনিট থেকেও বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বলা হয়েছে। তবে উচ্চ কম্পন ও কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে ইউনিটটিতে উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হয়নি।’
আদানির সঙ্গে কয়লার দামসহ বেশকিছু অনিষ্পন্ন ইস্যুর পাশাপাশি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে অস্বচ্ছতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাজারে কয়লার দাম এক রকম যাচ্ছে। আদানির পক্ষ থেকে আরেক রকম দাবি করা হচ্ছে। আবার আমরা এক রকম অর্থ পরিশোধ করছি। এ ধরনের কিছু ধারাবাহিক ইস্যু থেকে যায়। যেহেতু তাদের সঙ্গে আমাদের অনিষ্পন্ন কিছু বিষয় রয়েছে, সেগুলো আমরা পর্যায়ক্রমে নিষ্পত্তি করব। আমাদের একটি কমিটি রয়েছে, আদানিরও একটি কমিটি আছে এবং দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনাও হয়েছে। এসব অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো সমাধানে দুই পক্ষই কাজ করছে। একসময় এর সবগুলোই নিষ্পত্তি হবে। যেহেতু আদানির সঙ্গে আমরা একটি চুক্তিতে আছি এবং আমাদের বিদ্যুতেরও প্রয়োজন রয়েছে, তাই তাদের কাছে বিদ্যুৎ চাওয়া হয়েছে। কমিটির পক্ষ থেকে কোনো পর্যবেক্ষণ এলে এবং সে অনুযায়ী সরকারের কাছ থেকে নির্দেশনা এলে তখন আমরা এর ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেব। তার আগ পর্যন্ত আমরা স্বাভাবিকভাবেই চলার চেষ্টা করব।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আদানির সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল কিংবা সংশোধনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চাপ দেয়ার সুযোগ ছিল। এর পেছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। বৈশ্বিকভাবে বর্তমানে আদানির যে অবস্থান, তাতে গ্রুপটি এক ধরনের চাপের মধ্যে আছে। এটিও সরকারের পক্ষে যেত। এসব অনুকূল সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য সরকারের দিক থেকে তো উদ্যোগ থাকতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারের যথেষ্ট সংকোচ আছে এবং সরকার এক ধরনের আত্মসমর্পণ করছে বলে মনে হয়। তারা সেই পুরনো পথেই হাঁটবে লক্ষণ দেখে এ রকমই মনে হচ্ছে। আদানির চুক্তির বিষয়ে দলিলপত্র, আন্তর্জাতিক চাপ এবং জনমত সবকিছুই সরকারের অনুকূলে ছিল। সর্বোপরি সরকারের নিজেদেরও এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি ছিল। এ সবকিছুকে অবজ্ঞা করাটা অত্যন্ত খারাপ একটি দৃষ্টান্ত হবে এবং এর ফলে বড় একটি সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ।’
![অন্য দেশ বাতিল করলেও আদানির বিতর্কিত চুক্তি নিয়ে নত অবস্থানে অন্তর্বর্তী সরকার](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)