ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১০:২ এএম
অনলাইন সংস্করণ
অর্থবছরের প্রথমার্ধে চামড়া রপ্তানি কমলো ১১.৬৫%, সংকট আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে দেশের চামড়া রপ্তানি ১১.৬৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৬২.৪৮ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এই রপ্তানি ছিল ৭০.৭২
১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১০:২ এএম
![অর্থবছরের প্রথমার্ধে চামড়া রপ্তানি কমলো ১১.৬৫%, সংকট আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2025/02/10/20250210100231_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডাব্লিউজি) সনদ না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া খাতের মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারছে না দেশের ট্যানারিগুলো। ফলে ক্রমেই এই খাতে ব্যবসায়িক সংকট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে দেশের চামড়া রপ্তানি ১১.৬৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৬২.৪৮ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এই রপ্তানি ছিল ৭০.৭২ মিলিয়ন ডলার।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে ঢাকার হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়া শিল্প নগরীর একটি ট্যানারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশে ৪৭.২৫ বর্গফুট চামড়া রপ্তানি করে– যা থেকে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি আয় ছিল ৩৯.৪৬ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি আয় ৪৮ শতাংশ কমে ২০.৫৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডাব্লিউজি) সনদ ও আর কোনো বিকল্প না থাকায় অনেকটা এককভাবে চীন নির্ভর ব্যবসা করতে গিয়ে ক্রমশই এই খাতের ব্যবসায়িক সংকট বাড়ছে।
ট্যানারি মালিকরা অবশ্য এই সার্বিক পরিস্থিতির জন্য বিগত সরকারের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও অবহেলাকেই দায়ী করছেন। তারা বলছেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় এলডাব্লিউজি সনদ– যার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শিল্প নগরীর সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) ও সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টকে কমপ্লায়েন্সের আওতায় নিয়ে আসা।
তাদের দাবি, শিল্প নগরীর সিইটিপি ও ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টই এখন দেশের চামড়া সেক্টরের জন্য এলডাব্লিউজি সনদ প্রাপ্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। যদিও এই সমস্যার সমাধানে এখনো চূড়ান্ত কোনো রোডম্যাপ পাওয়া যায়নি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে এই শিল্পকে এলডাব্লিউজি সনদের জন্য অনতিবিলম্বে প্রস্তুত না করা হলে ভবিষ্যতে এই শিল্পের জন্য টিকে থাকাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
যদিও সংকটময় এই পরিস্থিতিতেও কিছুটা আশার কথা শোনাচ্ছেন শিল্প নগরীর সিইটিপি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম শাহনেওয়াজ।
তিনি বলেন, "আশার কথা হচ্ছে, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি এক্সপার্ট টিম ক্যাপাসিটি ইমপ্রুভমেন্ট থেকে শুরু করে সিইটিপি ও সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের সার্বিক দিক নিয়ে অ্যাসেসমেন্ট করবে। এক্সপার্ট টিমের অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট পাওয়ার পর আমাদের কী কী করণীয় আছে, কোথায় কোথায় আরও সংস্কার করা দরকার—এই সার্বিক বিষয়ে আমরা একটি রোডম্যাপ পেয়ে যাবো। সেই হিসাবে পরবর্তী যাবতীয় করণীয় নির্ধারণ করা হবে।"
"বাস্তবতা হচ্ছে এক বছর আগেও এই সিইটিপিটা আইসিইউ বা সিসিইউতে ছিল। সেখান থেকে এখন এটি বেশ ভালো একটি অবস্থানে রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু সংস্কার ও উন্নতি করা হয়েছে। সিইটিপির ট্রিটমেন্ট কোয়ালিটিও আগের চেয়ে এখন বহুগুণ উন্নত," যোগ করেন এই কর্মকর্তা।
ট্যানারি মালিকদের ১৩টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত লেদার ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট কমিটির (এলআইডিসি) সভাপতি মজিবুর রহমান -কে বলেন, "দেখতে দেখতে ৮ বছর পেরিয়ে গেছে। এই খাতের মূল যে সমস্যা, সেটির সমাধান এখনো করা সম্ভব হয়নি, বরং সরকার বিভিন্ন সময় নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে বিভিন্ন অযাচিত বিষয় ট্যানারিগুলোর উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।"
তিনি বলেন, "রপ্তানি হয়তো আপনি দেখছেন, কিন্তু কী দামে যে আমরা চামড়া বিক্রি করে টিকে আছি তা শুধু আমরাই জানি। ১.৬০ ডলারে একসময় বিক্রি করা চামড়া এখন ০.৬০ ডলারে বিক্রি করছি।"
তিনি আরও বলেন, "সিইটিপি ও ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট যতক্ষণ পর্যন্ত না ঠিক হচ্ছে, এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। সব ট্যানারির সেই স্পেস নেই যে, তারা নিজেরা ইটিপি করে নেবে। ক্রোম রিকোভারিরও বিষয় আছে। ছোট ট্যানারিগুলোর পক্ষে সেটি সম্ভব নয়।"
"আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাবো, যত দ্রুত সম্ভব শিল্প নগরীর সিইটিপি ও সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের যে ইস্যু, সেটির সুরাহার উদ্যোগ নিন। জোড়াতালি দিয়ে এটি কোনো দিন ঠিক হবে না। প্রয়োজনে দেশ থেকে হোক বা বিদেশ থেকে হোক, ফান্ড এনে এটি একবার ঠিক করুন, দেশের অর্থনীতিই এতে উপকৃত হবে, খাত বাঁচবে," যোগ করেন তিনি।
সালমা ট্যানারির মালিক ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ -কে বলেন, "এই সেক্টরের সংকট এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় সবারই জানা। এলডাব্লিউজি সনদ না থাকায় ইউরোপের বাজারে প্রবেশাধিকার নেই, ব্র্যান্ড বায়াররা আসতে পারছে না। চীন নির্ভর হওয়ার কারণে চীনের বায়াররা এখন এর সুযোগ নিচ্ছে। বিশেষ করে চীনের বায়াররা ক্রমাগত বিভিন্নভাবে চামড়ার দাম কমিয়ে দিচ্ছে।"
কীভাবে চীনা বায়াররা পণ্যের দাম কমাচ্ছে, তার উদাহরণ দিতে গিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, "ধরুন, কোনো একজন বায়ার ইএফজিএস গ্রেডের চামড়ার অর্ডার দিল। চামড়া রেডি করার পর ইন্সপেকশনে যখন তারা আসছে, তখন এর থেকে একটি বড় অংশের চামড়াকে তারা বিভিন্ন বাহানায় বাদ দিয়ে নতুনভাবে সেই চামড়াকে টিআর হিসাবে গ্রেডিং করে– যার মূল্য অনেক কম। অর্থাৎ, নিম্নমানের চামড়ার গ্রেডিংয়ে নিয়ে গিয়ে সেটিকে যে দামে চুক্তি হয়, তা থেকে অন্তত ২০ থেকে ২৫ সেন্ট কমিয়ে দিচ্ছে বায়াররা।"
"কমপ্লায়েন্স হওয়া ছাড়া, অর্থাৎ এলডাব্লিউজি সনদ ব্যতীত এই পরিস্থিতির সমাধান হবে না। যতদিন পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের সামনে নতুন বাজার উন্মুক্ত না হচ্ছে, বিদ্যমান সংকটগুলো শুধুই গভীর হবে। অনেক ট্যানারিই ইতোমধ্যে এলডাব্লিউজি সনদের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে নিয়েছে। বাধা সিইটিপি ও সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট। এটির সমাধান করা গেলে যাবতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে," যোগ করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
মো. সাখাওয়াত উল্লাহ আরও জানান, চলতি অর্থবছরে তার ট্যানারির রপ্তানিও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে যেখানে প্রায় ৪০ কোটি টাকার চামড়া রপ্তানি করেছিল, সেখানে চলতি বছরের একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি আয় ২০ কোটিও স্পর্শ করেনি।
সামিনা ট্যানারির ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আবদুল্লাহ আল মামুন টিবিএস-কে বলেন, চামড়া শিল্পের সংকট তো হাজারীবাগ থেকে সাভারে আসার পর থেকেই শুরু হয়েছে। বিশেষ করে এখন সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। চলতি অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির পরিমাণও অনেক কম বলে জানিয়েছেন তিনি।
চামড়া খাতের বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে এবিএস ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমাম হোসাইন বলেন, "লেদার সেক্টরের বর্তমান সংকট এতটাই গভীর যে, এভাবে চলতে থাকলে বহু ব্যবসায়ীই দেউলিয়া হয়ে যাবে।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন ট্যানারি মালিক বলেন, "বেশ কয়েকজন চীনা বায়ারের একটি গ্রুপ মিলে বর্তমানে এই সেক্টরে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তারা যা করে, সেটি হচ্ছে একটি ট্যানারিতে তারা ভালো গ্রেডিংয়ের চামড়ার অর্ডার দেয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন বাহানায় কখনো পুরো অর্ডার বাতিল করে অথবা তাদের জন্য প্রস্তুতকৃত চামড়ার একটি বড় অংশ তাদের চলবে না জানিয়ে বাদ দিয়ে দেয়। এরপর এই ব্যাপারটা তারা অন্যান্য বায়ার ও তাদের এজেন্সিগুলোকে জানিয়ে দেয়। এরপর আপনি আর কোনো বায়ারের কাছেই এই পণ্যের কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাবেন না।"
"বাধ্য হয়ে তাদের কারো কাছেই আপনাকে অন্তত ২০ থেকে ২৫ সেন্ট কম মূল্যে এই চামড়া বিক্রি করতে হবে," বলেন তিনি।
সালমা ট্যানারির মালিক ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ আরও বলেন, "গত ১৬ ডিসেম্বর তারিখে শিল্প ও বাণিজ্য উপদেষ্টা শিল্প নগরী পরিদর্শনের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের সাথেও বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ সময় উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, তারা এই শিল্পকে একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে উল্লেখ করে আগামী কোরবানির আগে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর কতটা সমাধান করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন।"
![অর্থবছরের প্রথমার্ধে চামড়া রপ্তানি কমলো ১১.৬৫%, সংকট আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)