ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৯:৪০ এএম
অনলাইন সংস্করণ
আট বছর পর আন্তর্জাতিক দরপত্র, কেউ সাড়া দেয়নি
১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৯:৪০ এএম
![আট বছর পর আন্তর্জাতিক দরপত্র, কেউ সাড়া দেয়নি](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2024/12/10/20241210094038_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
২০১৬ সালে আহ্বান করা আন্তর্জাতিক এক দরপত্রের ভিত্তিতে বঙ্গোপসাগরের গভীরে ১২ নম্বর ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের কাজ পেয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানি পস্কো দাইয়ু। যদিও পেট্রোবাংলার সঙ্গে দাম নিয়ে মতবিরোধের কারণে একপর্যায়ে ব্লকটি থেকে গ্যাস না তুলেই চলে যায় কোম্পানিটি। পস্কো দাইয়ু এখন ওই ব্লকের পাশেই মিয়ানমার অংশে সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ঘেঁষে অবস্থিত মিয়া ও শোয়ে কূপ থেকে কোম্পানিটি এরই মধ্যে কয়েক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তুলেছে। স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এ গ্যাস পাইপলাইনে করে চীনে রফতানিও হয়েছে।
এ সময়ের মধ্যে দীর্ঘদিন সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আর কোনো দরপত্র আহ্বান করেনি পেট্রোবাংলা। প্রায় আট বছর বিরতির পর চলতি বছরের ১০ মার্চ বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। শুরুতে এ দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল গত ১০ সেপ্টেম্বর। পরে তা আরো তিন মাস বাড়িয়ে গতকাল ৯ ডিসেম্বর বেলা ১টা পর্যন্ত এ দরপত্র জমা দেয়ার শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়। সময়সীমা বাড়ানোর পরও পেট্রোবাংলার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দরপত্র জমা দেয়নি কোনো তেল-গ্যাস কোম্পানি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পেট্রোবাংলার আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দরপত্রের নথি কিনেছিল বিদেশী সাতটি কোম্পানি। আর আগে করা বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য-উপাত্ত কিনেছিল আরো দুটি কোম্পানি। যদিও তাদের কেউই শেষ পর্যন্ত দরপত্র জমা দেয়নি। এখন নতুন করে দরপত্রের আহ্বানে সাড়া না পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণ করবে পেট্রোবাংলা। এরপর বিষয়টি নিয়ে জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল ও শেভরন, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস, নরওয়ে ও ফ্রান্সের যৌথ বিনিয়োগী কোম্পানি টিজিএস অ্যান্ড স্লামবার্জার, জাপানের ইনপেক্স করপোরেশন ও জোগোম্যাক, চীনের সিনুক, সিঙ্গাপুরের ক্রিস এনার্জি এবং ভারতের ওএনজিসি আগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন সময় পেট্রোবাংলার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এর মধ্যে সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনেছিল শেভরন, এক্সনমবিল, ইনপেক্স, সিনুক ও জোগোম্যাক। শেষ পর্যন্তু তাদের কেউই দরপত্র জমা দেয়নি।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দরপত্র কেনা কোম্পানিগুলোর মধ্যে কয়েকটি চূড়ান্তভাবে দরপত্র জমা দেবে বলে ধারণা করছিলেন তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই তা জমা না দেয়ার কারণ এবং এ বিষয়ে তাদের ভাবনা প্রসঙ্গে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এরপর পরবর্তী করণীয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট) প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কয়েকটি বিদেশী কোম্পানি দরপত্র কিনেছিল। আমরা আশাবাদীও ছিলাম যে তারা দরপত্র জমা দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেয়নি। এখন নতুন করে আবার পেট্রোবাংলা আলোচনা করবে। দরপত্রে কেন বিদেশী কোম্পানি এল না, সেটি বিশ্লেষণ করা হবে। দরপত্রে কোনো কিছু পরিবর্তন করা যায় কিনা, সেটিও দেখা হবে।’
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় ২০১২ সালে। এরপর ২০১৪ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে। এরপর ২০১৯ সালে নতুন পিএসসি (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট বা উৎপাদন বণ্টন চুক্তি) করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি। এরপর তিন বছর সময় নিয়ে নতুন পিএসসি ২০২৩ চূড়ান্ত করা হয়। সমুদ্রে বহুমাত্রিক জরিপ চালিয়ে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় অনেক বিদেশী কোম্পানি আগ্রহ দেখাচ্ছিল। দরপত্রে অংশ নিতে ৫৫টি কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
এর আগে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সাতটি বিদেশী কোম্পানি দরপত্র কিনেছে বলে চলতি বছরের মে মাসে বিডিং রাউন্ডসংক্রান্ত একটি সেমিনারে জানিয়েছিলেন তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সে সময় তিনি বলেছিলেন, পিএসসি আকর্ষণীয় করায় আরো অনেক বিদেশী কোম্পানি বাংলাদেশের সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
যদিও দরপত্র আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে আশাব্যঞ্জক সাড়া মেলার কোনো লক্ষণ না থাকায় পরে এ সময়সীমা আরো তিন মাস বাড়িয়ে চলতি মাসের ৯ ডিসেম্বর সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই দরপত্র জমা দেয়নি।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার অন্তত চার শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী না হওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাসও এক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ পিএসসিতে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা রয়েছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের মূল্যের ভিত্তিতে। সেক্ষেত্রে বাজারে ব্রেন্টের মূল্যহ্রাসে গ্যাসের দামও কমে যাওয়ার কথা।
দরপত্র কেনা কোম্পানিগুলোর মধ্যে এক্সনমবিল আগেই জানিয়েছিল, তারা এ অনুসন্ধানে অংশ নেবে না। অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্তত দুটির স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেট্রোবাংলার আহ্বানকৃত দরপত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে। প্রথমত, পেট্রোবাংলার জরিপের তথ্য-উপাত্তে সাগরতলে গ্যাসের উপস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি। সেখানে জ্বালানি তেলের লাভজনক বা সম্ভাব্য উপস্থিতি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পায়নি কোম্পানিগুলো। ফলে সাগরের তেল-গ্যাস উত্তোলনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগের পর শুধু গ্যাস বিক্রি করে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা পাওয়া যাবে না বলে মনে করছে তারা। এর বাইরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরিবেশ অস্থিতিশীল রয়েছে। ফলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের মতো বড় অংকের বিনিয়োগ নিয়ে এখনই কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না কোম্পানিগুলো।
পেট্রোবাংলার সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানসংক্রান্ত বহুমাত্রিক জরিপের তথ্য কিনেছিল মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। কোম্পানিটি বর্তমানে বাংলাদেশে বিবিয়ানাসহ মোট তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র পরিচালনা করছে। সেই সঙ্গে দেশে গ্যাস সরবরাহে অবদান রাখছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। দরপত্রে অংশ না নেয়ার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানায়নি মার্কিন কোম্পানিটি।
যোগাযোগ করা হলে শেভরন বাংলাদেশের কমিউনিকেশন ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান বলেন, ‘অংশীদারত্ব অব্যাহত রাখা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করার বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে কোনো ধরনের মূল্যায়ন বা কারিগরি কাজের বিষয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করব না। আমরা মনে করি সব ধরনের জ্বালানিই গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানি খাতের বৈচিত্র্যায়ণ ও তাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গত ৩০ বছরে দেশের ভূখণ্ডে গ্যাস সম্পদের নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য উন্নয়নে আমরা ৪১০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছি, যার মধ্যে স্থানীয় সরবরাহকারীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে করা ৫৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগও রয়েছে। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের প্রয়োজন মেটানো এবং জ্বালানির স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার ক্ষেত্রে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।’
সময় বাড়ানোর পরও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দরপত্র জমা না দেয়ার বিষয়টি অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করা হবে বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার। তার ভাষ্যমতে, ‘দরপত্র কেনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে। পেট্রোবাংলা নিজেও দরপত্রের বিষয়টি পুনরায় মূল্যায়ন করবে। এর পরই পুনরায় দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
জ্বালানি বিভাগসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তুলতে পিএসসিকে আকর্ষণীয় করা হয়েছে। আগের পিএসসিগুলোয় গ্যাসের দর স্থির করা ছিল। নতুন পিএসসিতে গ্যাসের দর নির্ধারণ করা হয়নি। বরং এটিকে ব্রেন্টের আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সাগরে পাওয়া প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্টের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের ১০ শতাংশের সমান। অর্থাৎ ব্রেন্টের দাম ৯০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ৯ ডলার। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজার আদর্শটির দাম বাড়লে গ্যাসের দামও বাড়বে। একইভাবে ব্রেন্টের দাম কমলে গ্যাসেরও কমবে। আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্টের দাম (স্পট) এখন প্রতি ব্যারেল ৭২ ডলার ৩৯ সেন্ট। সে অনুযায়ী সাগর থেকে উত্তোলিত গ্যাসের দাম হয় প্রতি হাজার ঘনফুটে প্রায় ৭ ডলার ২৪ সেন্টে। আর এ দরপত্র আহ্বানের সময় ব্রেন্টের ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ৯০ ডলারের বেশি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে পিএসসি পুনর্মূল্যায়ন করা হবে।’
![আট বছর পর আন্তর্জাতিক দরপত্র, কেউ সাড়া দেয়নি](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)