ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ১১:৩০:২৭ এএম

উদ্বৃত্ত থেকে সংকটে, মিয়ানমার-বাংলাদেশের গ্যাস পরিস্থিতি

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ৯:৫৩ এএম

উদ্বৃত্ত থেকে সংকটে, মিয়ানমার-বাংলাদেশের গ্যাস পরিস্থিতি

ছবি: সংগ্রহ

প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গ্যাসের মজুদ আছে প্রায় ২৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এক সময় বলা হতো দেশটিতে গ্যাসের যে পরিমাণ মজুদ রয়েছে তা দিয়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো যাবে অন্তত ১৫০ বছর। উদ্বৃত্ত গ্যাস দীর্ঘদিন চীন ও থাইল্যান্ডে রফতানি করেছে দেশটি। কিন্তু বর্তমান গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির উত্তোলন কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। মিয়ানমারে কার্যক্রম চালানো বন্ধ করে দিয়েছে পশ্চিমা বেশকিছু কোম্পানি। বর্তমানে ব্যাপক পরিমাণে উদ্বৃত্ত নিয়েও গ্যাস সংকটে ভুগছে দেশটির ভোক্তারা।

 

যদিও একসময় গ্যাস খাতে মিয়ানমারের সম্ভাবনা অনুধাবন করে সেখানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে বিদেশী তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো। কিন্তু দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভূরাজনৈতিক সংকট মিয়ানমারে তাদের কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়ে। সর্বশেষ ২০২১ সালে দেশটির সামরিক জান্তার অভ্যুত্থান ও নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পর দেশটির অস্থিতিশীলতা চরমে পৌঁছায়। রাজনৈতিক বিরোধ রূপ নেয় গৃহযুদ্ধে।

 


গ্যাস উদ্বৃত্তের দেশ বলা হতো বাংলাদেশকেও। দেশে গ্যাস খাতে এখন পর্যন্ত প্রমাণিত মজুদ প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। যদিও এ মজুদের মধ্যে ২১ টিসিএফের বেশি উত্তোলন হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের চালানো সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে বাংলাদেশে গ্যাস মজুদের পরিমাণ আরো বেশি হতে পারে।

 

যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোভিত্তিক কনসালট্যান্সি ফার্ম গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটস ২০১১ সালে গ্যাসের মজুদ নিয়ে এক প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। ওই প্রতিবেদনে গুস্তাভসন জানায়, দেশের গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ ৩৮ টিসিএফ। ৫০ শতাংশ মজুদ সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোয় এর পরিমাণ ৬৩ টিসিএফের কিছু বেশি। এ তথ্য ২০১১ সালে এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হলেও গ্যাস মজুদ নিয়ে গুস্তাভসনের তথ্য মোটেও বিশ্বাস করেনি সরকার। ওই প্রতিবেদনে ৫০ শতাংশ মজুদ সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোয় এর পরিমাণ ৬৩ টিসিএফের কিছু বেশি বলে জানানো হয়। 

 

বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমারের সরকার। একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে উত্তোলিত গ্যাসের ওপর নির্ভর করে জ্বালানি পরিকল্পনা নতুন করে সাজিয়েছে দেশটির সরকার। মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশ সরকারও চলতি বছরের মার্চে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। বহুজাতিক কয়েকটি কোম্পানি এতে আগ্রহও প্রকাশ করেছে। 

 

 কিন্তু দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা গৃহযুদ্ধের দিকে মোড় নিতে থাকলে সেখান থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ চলতি বছরের এপ্রিলে থাই রাষ্ট্রায়ত্ত ফসিল ফুয়েল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান পিটিটি এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি জানায়, মিয়ানমারে শেভরনের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ইউনোকল মিয়ানমার অফশোর কোম্পানি দেশটির ইয়াদানা গ্যাস প্রকল্প থেকে তাদের বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে।

 

দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে ইতিহাসটা বেশ পুরনো। স্বাধীনতাপরবর্তী তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ১৯৭৪ সালে প্রথম পিএসসির আওতায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। তবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর তৎপরতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় নব্বইয়ের দশকে। পিএসসির আওতায় নব্বইয়ের দশকে দুটি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর আওতায় চালানো অনুসন্ধানের ফলাফল হিসেবে আসে পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের তথ্য। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ১৯৯৩ সালে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি সই করে পেট্রোবাংলা।

 

স্থলভাগে আরো বড় আকারে গ্যাস অনুসন্ধানে ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। পিএসসির আওতায় চারটি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য এ দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। এতে ৫ নম্বর ব্লকে যৌথভাবে শেল ও কেয়ার্ন এনার্জি, ৭ নম্বর ব্লকে ইউনোকল, ৯ নম্বর ব্লকে তাল্লোর সঙ্গে শেভরন-টেক্সাকো এবং ১০ নম্বর ব্লকে শেল ও কেয়ার্ন এনার্জি যৌথভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করে। এর আওতায় ৯ নম্বর ব্লকে আবিষ্কার হয় বাঙ্গুরা গ্যাস ক্ষেত্র। তাল্লোর আবিষ্কৃত ওই গ্যাস ক্ষেত্রে ১ হাজার ১০০ বিলিয়ন কিউবিক ফিট (বিসিএফ) গ্যাস পাওয়া যায়।

 

পিএসসির আওতায় ২০০৮ সালে অফশোরের দুটি ব্লকে দরপত্র আহ্বান করা হয়। ডিএস-৮ ও ডিএস-১০ ব্লকের আওতায় যৌথভাবে গ্যাস অনুসন্ধানে চুক্তি স্বাক্ষর করে কনোকোফিলিপস ও বাপেক্স। যদিও এতে বড় কোনো গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। একই পদ্ধতিতে ২০১২ সাল পর্যন্ত আরো তিনটি ব্লকের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। 

 

এরপর ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইন-২০১০ (বিশেষ আইন)-এর আওতায় দুই ধাপে পসকো দাইয়ু করপোরেশনকে ডিএস-১০, ১১, ১২ ও এসএস-১০ ব্লক ইজারা দেয়া হয়। অফশোরে ভারতীয় কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ ছাড়া ইজারা দেয়া অন্য সব প্রতিষ্ঠান ব্লক ছেড়ে চলে গেছে।

 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান করা যায়নি, তার প্রধানত কারণ অনুসন্ধানে অনাগ্রহ ছিল। অন্যদিকে আমদানির প্রতি মনোযোগও ছিল অনেক বেশি। ফলে গ্যাস ব্যবহার হয়েছে কিন্তু রিজার্ভের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে নানা সময়ে অভ্যন্তরীণ ও ভূরাজনীতিও কাজ করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর সমুদ্রে বড় আকারে গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটি করা যায়নি।

 

সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পর বিদেশী তেল-গ্যাস কোম্পানি এনে মিয়ানমার গ্যাস কূপ খনন করে গ্যাস পেয়েছে। অন্তত দু-দশকের বেশি সময় অভ্যন্তরীণ ও ভূরাজনৈতিক কারণে গ্যাস খাতে অনুসন্ধান করা যায়নি। গ্যাস পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকলেও বহু জায়গা অনুসন্ধানের বাইরে থেকেছে।

 

২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয়। এরপর ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রে কোনো ধরনের তৎপরতা দেখাতে পারেনি। বরং ভারত গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান চালিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বড় সাফল্য পেয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে গভীর সমুদ্রে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের বড় মজুদ আবিষ্কার করেছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস করপোরেশন লিমিটেড (ওএনজিসি)।

 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গ্যাস অনুসন্ধানে মিয়ানমার কিছুটা হলেও এগিয়েছিল। কিন্তু দেশটির সেনাশাসন ও নানাবিধ অভ্যন্তরীণ সংকটে এগোতে পারেনি। বাংলাদেশ গ্যাস অনুসন্ধানে বলা যায় মোটা দাগে ব্যর্থ হয়েছে। গ্যাস পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কখনো বিশ্বাস করতে পারেনি এখানে গ্যাস রয়েছে। যে কারণে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও ভূরাজনীতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে পরতে পরতে। 

 

জ্বালানি বিভাগের দাবি, গত ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে ছয়টি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এ সময়ে ২১টি অনুসন্ধান কূপ, ৫০টি উন্নয়ন কূপ এবং ৫৬টি ওয়ার্কওভার কূপ খনন করা হয়েছে। এছাড়া ছয় হাজার কিলোমিটার থ্রিডি সিসমিক সার্ভে, ১ হাজার ৩৫৫ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন, জ্বালানি তেলের মজুদাগার এবং সরবরাহ পাইপলাইন নির্মাণ বাড়ানো হয়েছে।

 

দেশে গ্যাস খাতে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে পেট্রোবাংলা এখন ৫০টি কূপ খনন করছে। এর বাইরে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে আরো অন্তত ১০০টি গ্যাস কূপ খনন করতে চায়, যেখানে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।

 

উদ্বৃত্ত থেকে সংকটে, মিয়ানমার-বাংলাদেশের গ্যাস পরিস্থিতি