ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৪:২০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
খাদ্যশস্যের সরকারি বিতরণ বাড়েনি, মজুদ কমেছে ৩৯.৭৫%
৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৪:২০ পিএম
![খাদ্যশস্যের সরকারি বিতরণ বাড়েনি, মজুদ কমেছে ৩৯.৭৫%](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2024/12/06/20241206112758_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
মূল্যস্ফীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অংশ হিসেবে সরকারিভাবে টিসিবি, ওএমএসসহ বেশকিছু কার্যক্রমের আওতায় খাদ্যশস্য (চাল ও গম) বিতরণ করে থাকে সরকার। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রায় প্রথম পাঁচ মাস (১ জুলাই থেকে ২৩ নভেম্বর) সময়ের মধ্যে আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) একই সময়ের তুলনায় খাদ্যশস্য বিতরণ বাড়েনি। উল্টো তা হ্রাস পেয়েছে ৭১ হাজার ৩১৮ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকারি ভাণ্ডার থেকে খাদ্যশস্য বিতরণ হয়েছে ১২ লাখ ৯১ হাজার ৭৬৮ টন। আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময় বিতরণ হয়েছে ১২ লাখ ২০ হাজার ৪৫০ টন।
বিতরণ না বাড়লেও দেশে সরকারি খাদ্যভাণ্ডারের মজুদ এখন দ্রুতগতিতে কমছে। গত চার মাসে দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ কমেছে ৩৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রাক্কালে গত ৭ আগস্ট দেশে মোট খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ১৮ লাখ ৯ হাজার ৮৫৭ টন। এর মধ্যে চাল ও গমের মজুদ ছিল যথাক্রমে ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৭৪ টন ও ৪ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৩ টন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন খাদ্যশস্যের মোট মজুদ নেমে এসেছে (৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদকৃত) ১০ লাখ ৯০ হাজার ৩১৪ টনে। এর মধ্যে চালের মজুদ রয়েছে ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৩৪১ টন। গমের মজুদ আছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩০৩ টন। সে অনুযায়ী, চার মাসে দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ কমেছে ৭ লাখ ১৯ হাজার ৫৪৩ টন।
প্রসঙ্গত, এখানে সরকারি মজুদ ধানকেও চালের আকারে মজুদের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ উৎস ও আমদানির মাধ্যমে চাল ও গম সংগ্রহ করে থাকে সরকার। খাদ্যশস্যের রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারে মজুদ টানা কমে আসার পেছনে প্রধানত সরকারিভাবে সময়মতো আমদানি করতে না পারাকে দায়ী করছেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, দেশে গত কয়েক মৌসুমে খাদ্যশস্যের রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে বলে বিগত সরকারের সময়ে বারবার দাবি করা হয়েছে। এর পরও দফায় দফায় চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। সে হিসেবে এবারো বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আরো আগে থেকেই সরকারিভাবে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ ছিল।
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সরকার চাল বিতরণ করেছে ১০ লাখ ৪২ হাজার ৩৪৬ টন। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ৯ লাখ ৭২ হাজার ৯১৬ টন। গম বিতরণের চিত্রে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সরকার গম বিতরণ করেছে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৪২২ টন। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৪ টন।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে আমন মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলছে। বন্যায় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবার অভিযানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না-ও হতে পারে। তবে তা মজুদ বৃদ্ধি ও বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। কারণ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে সরকারিভাবে চাল আমদানির কার্যক্রম এরই মধ্যে অনেকটা এগিয়েছে। কয়েকটি চালান এরই মধ্যে প্রক্রিয়াধীন। আরো কয়েকটি উৎস থেকে আমদানির আলোচনাও শুরু হয়েছে। সুতরাং, সরকারি মজুদ নিয়ে এ মুহূর্তে উদ্বেগের কিছু নেই।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পর্যাপ্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। বিগত সরকারের আমলে অর্থনীতির সবকিছু ক্রমেই ভেঙে পড়ছিল। আগস্টে নতুন সরকার গঠন হলো। এখন আমরা কাজ করছি। ঠিক করতে কিছুটা সময় লাগবে। যেহেতু আমাদের এখানেই উৎপাদন হয়, তাই আমরা চাল আমদানিতে নিরুৎসাহিত করতাম। কিন্তু এবারের দুটি বন্যায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে আমন উৎপাদনের সময় বন্যার জন্য আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছি। ফলে আমরা এনবিআরের সঙ্গে কথা বলেছি চাল আমদানিতে ট্যাক্স কমানোর জন্য। এছাড়া আন্তর্জাতিক কিছু নিয়ম আছে, সেখানে ৪৫ দিন আগে টেন্ডার করতে হয়।
সবকিছু মিলে আমরা প্রক্রিয়া শুরু করেছি। চালের তিনটি বিড সফল হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমদানির উৎস একটিই ভারত। সেখান থেকে এখনো চালবাহী জাহাজ এসে পৌঁছায়নি। তাই বলে আমরা বসে নেই। মিয়ানমার থেকে ১ লাখ টন চাল আমদানির কার্যক্রম শুরু করেছি। ভিয়েতনাম ও পাকিস্তান থেকে (জিটুজি) চাল আনার বিষয়েও আলোচনা চলছে। আর ইউক্রেন থেকে ৭ ডিসেম্বর গমের একটি জাহাজ আসবে। ইউক্রেন ও আর্জেন্টিনা থেকে আরো দুটি গমের চালান আসবে। গম নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক পরিস্থিতিতে আমদানিতে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করি না। কারণ আমরা বলেছি এসব বিষয় যেন বাণিজ্যের সঙ্গে মেলানো না হয়। আমাদের ৫০ হাজার টনের যে বিড অনুমোদন হয়েছে সেটির উৎস কিন্তু ভারত।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ায় বিতরণে কিছুটা ভাটা দেখা গেছে। সরকার যখন একটু শক্ত হয়ে দাঁড়াল, তখন সবকিছু স্বাভাবিক করা হয়েছে। বর্তমানে টিসিবির মাধ্যমে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টন শুধু চালই বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া ওএমএসসহ আরো বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলো চলমান আছে। আর মজুদ কমে যাওয়া নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা কেবল একটি উৎসের ওপর নির্ভর করে বসে নেই। বহু উৎস থেকে সংগ্রহের বিষয়ে কাজ করছি। আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যেমন সংগ্রহ চলছে, তেমনি আমদানি নিয়েও কাজ চলছে।’
চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়েছে ২৩ হাজার টনের কিছু বেশি। গম আমদানির বিষয়টিও এখন মূলত বেসরকারি খাতের ওপরই নির্ভরশীল। চলতি অর্থবছরে সরকারিভাবে গম আমদানি হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার টন। আর বেসরকারিভাবে হয়েছে প্রায় ১৯ লাখ ৮০ হাজার টন। চাল ও গম মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে দেশে মোট খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে (সরকারি ও বেসরকারিভাবে) প্রায় ২২ লাখ ৬৩ হাজার টন।
দেশের খাদ্যপণ্যের বাজারে উচ্চ মূল্যস্ফীতির পেছনে প্রধানত চালের দামকেই বেশি দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। তাদের ভাষ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে ভরা মৌসুমেও চালের বাজারে অস্থিরতা দেখা গেছে। বর্তমানে সরকারিভাবে চাল আমদানিতে যে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, অন্তত আরো এক মাস আগে এ উদ্যোগ শুরু করা গেলে তা বাজার স্থিতিশীলতায় আরো কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারিভাবে খাদ্যশস্যের বিশেষ করে চালের আমদানি বাড়ানোর দিকে আরো মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে তা আরো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে সে কারণে সামনে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিতও হতে পারে। সেটি মাথায় রেখে সরকারের মজুদ বৃদ্ধি করা দরকার। ন্যূনতম ১২ লাখ টন চালের মজুদ থাকা লাগে। বর্তমানে মজুদ প্রায় সাত লাখ টন। ফলে মজুদ বৃদ্ধি করতে হবে। বিভিন্ন উৎস থেকে সেটি সংগ্রহ করতে হবে। বর্তমানে চাল আমদানির যে লক্ষ্য সেটি পূরণ হয়ে গেলে মোটামুটি চালের মজুদ ১৫ লাখ টনের বেশি হয়ে যাবে। ফলে এটি নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে সরকারিভাবে খাদ্য আমদানি আরো বাড়ানো দরকার। কারণ বেসরকারিভাবে আমদানি করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন দেশের বাজারে দাম অনেক বেশি। ফলে সেখান থেকে আমদানি করে এখানে বিক্রি করাটা সম্ভব হবে না। তবে আমার মনে হয়, এর পাশাপাশি দেশে উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোযোগ বাড়ানো দরকার। সেটি দেশের জন্য বেশি সুবিধাজনক হবে।’
জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ২০ শতাংশ মানুষ। আর প্রয়োজনীয় খাদ্য সংস্থান করতে পারছে না প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন বা ৩০ শতাংশ। নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। খাদ্যে ব্যয় সংকোচনমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে ২৯ শতাংশ মানুষ। আর সার্বিক জীবন-জীবিকায় ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে ৭১ শতাংশ মানুষ।
খাদ্যশস্যের মজুদ বৃদ্ধি এবং বিতরণ কার্যক্রম আরো জোরালো করার মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগা এসব মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার বিষয়ে অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
![খাদ্যশস্যের সরকারি বিতরণ বাড়েনি, মজুদ কমেছে ৩৯.৭৫%](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)