ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
৪ নভেম্বর, ২০২৪ | ৪:৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ
খেলছে সিন্ডিকেট, হাতে নেই চালের বাজার
৪ নভেম্বর, ২০২৪ | ৪:৫ এএম
ছবি: সংগ্রহ
ভরপুর উৎপাদন, শুল্ক কমে তলানিতে, আমদানির দরজাও খোলা; পাশাপাশি জোরদার বাজার তদারকি কার্যক্রম। সরকারের এতসব আয়োজনেও বাগে আসছে না চালের বাজার। গেল এক মাসে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে চালের দাম। পর্দার আড়ালে বাজারে খেলছে ‘সিন্ডিকেট’। ফলে বিফলে যাচ্ছে সরকারের ইতিবাচক সব উদ্যোগ।
আরও পড়ুন
খাদ্যশস্য মজুতেরও আছে নিয়ম। তবে সেই নিয়মের ধার না ধেরে হাজার হাজার টন চাল গুদামে ভরে রেখেছেন উৎপাদন এলাকার মিলার ও মজুতদাররা। চালের সংকট না থাকলেও বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিমভাবে দামের ঘোড়া ছোটাচ্ছেন তারা। এ কারসাজির সঙ্গে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান, আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধা পাওয়া বড় মিলার ও উৎপাদন অঞ্চলের কিছু পাইকারি ব্যবসায়ী জড়িত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩৬ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। তবে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ২০ লাখ টন। সে হিসাবে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়েছে ৩০ লাখ টনের মতো। এতে চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক বন্যায় ৮ লাখ ৩৯ হাজার টন চালের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। মিলারার বন্যার উছিলা আর মজুত ফুরিয়ে আসছে বলে ধুয়া তুলে ভোক্তার পকেট কাটছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের শুরু থেকেই এবার চালের বাজার ছিল চড়া। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের সময় তা আরও বেড়ে যায়। এর পর আর স্বস্তি ফেরেনি বাজারে। গত সপ্তাহে আরেক দফা বেড়েছে দাম। বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা মাঝারি আকারের বিআর-২৮ ও পাইজাম জাতের চালের। এ ধরনের চালের ভোক্তা সাধারণত মধ্যবিত্ত। গত শুক্রবার ঢাকার বাজারে খুচরা পর্যায়ে এ দুই জাতের চালের কেজি বিক্রি হয়েছে ৫৮-৬৪ টাকায়। এ ছাড়া মোটা চালের (গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজি ৫২-৫৫ টাকা ও চিকন চাল (মিনিকেট) বিক্রি হয়েছে কেজি ৭০-৮০ টাকা দরে। মাস তিনেক আগে মোটা চালের কেজি ৪৮-৫০, মাঝারি চাল ৫৪-৫৮ এবং চিকন চাল ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে, গেল এক মাসে সরু চালের দর প্রায় ৪ শতাংশ, মাঝারি চালের ৮ ও মোটা চালের দর ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে এক বছরের ব্যবধানে এই হার আরও বেশি। এ সময় সব ধরনের চালের দর বেড়েছে গড়ে ১২ শতাংশ।
চালের দামের এমন লম্ফঝম্ফ শুধু ঢাকায় নয়, উৎপাদন অঞ্চলেও বাড়ছে দর। গেল এক সপ্তাহে নওগাঁর বাজারে বস্তায় (৫০ কেজি) ২৫০-৩০০ টাকা বেড়েছে। ফলে গত বৃহস্পতিবার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কাটারিভোগ ৭০-৭১ টাকা, জিরাশাইল ৬৭-৬৮, সুভলতা ৬০-৬২, পারিজা ৫৮-৬০, ব্রি আর-২৮ ও ২৯ চাল ৬০-৬২ এবং স্বর্ণা জাতের চাল ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। দামের ক্ষেত্রে প্রায় একই চিত্র রয়েছে বগুড়া, দিনাজপুর ও কুষ্টিয়ায়।
বগুড়ার শেরপুরের বিভিন্ন হাটবাজারে ধান-চাল ব্যবসায়ীরা জানান, এসিআই, রূপচাঁদা, আকিজ, পুষ্টিসহ বেশ কিছু কোম্পানি চালের দামে ফায়দা লুটছে। তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান-চাল কিনে গুদামজাত করে। পরে সুবিধামতো সময়ে নিজ নিজ ব্র্যান্ডের প্যাকেটে মোড়কজাত করে বেশি দামে বিক্রি করে। নওগাঁর ব্যবসায়ীরাও বলছেন, তাদের চাল দিয়ে দেশের একটি বড় অংশের চাহিদা মেটে। সেখানে নিজ এলাকাতেই প্রতিদিন চালের দাম বাড়ছে। এর পেছনে যে সিন্ডিকেট জড়িত, তা সহজে অনুমেয়।
নওগাঁর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ চাল মজুত করে রাখা হয়েছে। চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব গুদামে এবং বাইরের বিভিন্ন গুদামে হাজার হাজার টন চাল মজুত রেখেছেন। মজুতদারিতে এগিয়ে আছে সুলতানপুর-কালীতলা রোডের শফিকুল ইসলাম নাঠুর সুফিয়া অটো রাইস মিল, লস্করপুর এলাকার দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষের ঘোষ অটো রাইস মিল। এই দ্বিজেন্দ্রনাথই আবার পরিতোষ নামে এক ব্যবসায়ীর নওগাঁ শহর ও তিলকপুর রোডে একাধিক গুদামে চাল রেখেছেন। আলুপট্টির চাল ব্যবসায়ী মনোরঞ্জন ওরফে মনা বাবুর বেশ কিছু গুদামেও চালের মজুত রয়েছে। মনোরঞ্জন হলেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ছোট ভাই। খাদ্য বিভাগে এখনও তাঁর অদৃশ্য ইশারা জারি আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
মজুতদারিতে আরও জড়িত রয়েছে শহরের সুলতানপুর এলাকায় নীরব বরণ সাহা চন্দনের একতা রাইস মিল, চকোরির দুলাল বাবু এবং আনন্দনগর এলাকায় নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের এমআর রাইস মিল, নওগাঁর সান্তাহার সীমান্তে সাহাপুর এলাকায় স্বপনের নাইট অটোমেটিক মিল, একই এলাকায় সিরাজুল অটো রাইস মিল, বাইপাস কোমাইগাড়ী এলাকার মাহবুব অটোমেটিক রাইস মিল, বাইপাস বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় তোছিরন অটো রাইস মিল, মাদার মোল্লা এলাকার মফিজ অটো রাইস মিল ও আজিজুল হকের গুদাম। মহাদেবপুরে আকিজ ও সরস্বতীপুর এলাকায় এসিআইর বেশ কয়েকটি বড় গুদাম আছে। এসব গুদামেও হাজার হাজার টন চাল মজুত রয়েছে।
তবে দিনাজপুরের চাল ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ অটো-মেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি শহীদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন বলেন, এখানকার মিলারদের কাছে মজুত বেশি নেই। ১৫ দিন পর নতুন ধান আসবে। এ কারণে মজুতদাররাও চাল ছেড়ে দিচ্ছেন। মৌসুমি মজুতদাররাই মূল সমস্যা। এরা ব্যবসা না বুঝেই অন্য পণ্যের মতো ধান-চাল মজুত করে।
মজুতদারিতে অভিযুক্ত বেশির ভাগ কথা বলতে না চাইলেও নওগাঁর ঘোষ অটোমেটিক রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, মিলে পুরোনো কোনো ধান-চাল মজুত নেই। মোকামে কেনাবেচা না থাকায় ব্যবসা মন্দা চলছে। অবৈধ মজুতের অভিযোগ সত্য নয়।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, নওগাঁর চাল দিয়ে দেশের একটি বড় অংশের চাহিদা মেটে। তবে এ এলাকাতেই দাম বাড়ানোর পেছনে সিন্ডিকেট জড়িত, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, এবার ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এ কারণে চাল উৎপাদন বেশি। বাজারে চালের সংকট সৃষ্টির বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক।
চালের সরবরাহ বাড়াতে আমদানিতে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার। আমদানিতে মোট করভার ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে দুই দফা কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশ অগ্রিম কর রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আমদানিতে ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ককর প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাতে চালের আমদানি মূল্য কেজিতে প্রায় ৯ টাকা ৬০ পয়সা কমার কথা। শুল্ক প্রত্যাহার হলেও চক্রটি মজুত চাল বেশি দামে বিক্রির জন্য আমদানি করছে না। বন্যার ছুতায় আমদানিতে নিরুৎসাহিত করছে অন্যদেরও। তাতে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির চেষ্টা চলছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত চাল আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৯৫৭ টন। এ ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯৩৪ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ লাখ ৩৭ হাজার ১৬৮ টন এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু ৪৮ টন চাল আমদানি হয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে চালের মজুত রয়েছে ৯ লাখ ৬৮ হাজার টন। তবে সরকারের নিরাপত্তা মজুত হিসেবে সাধারণত ১১ লাখ টন চাল রাখার কথা বলা হয়ে থাকে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানির জন্য বাজেট ২ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বাকি ৭ লাখ ৫০ হাজার টনের জন্য আরও ছয় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ লাগবে।
নওগাঁ চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, পরিবহন শ্রমিক ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। এসবের প্রভাব পড়েছে চালের দামে। তা ছাড়া প্রতিবছর এ মৌসুমে দাম কিছুটা বাড়ে। শেরপুর উপজেলা ধান-চাল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল হামিদ বলেন, ধানের জোগান কম, এ কারণে চালের দাম বেড়েছে। তবে এই সমস্যা থাকবে না বেশি দিন। আগাম জাতের আমন ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে বাজার ঠিক হয়ে যাবে।
খাদ্য সচিব মাসুদুল হাসান বলেন, চালের যে সংকট নেই, তা পুরোপুরি সত্য। কারণ, আমি নিজে কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখেছি, প্রতিটি আড়ত চালে ভরা। অন্য জেলাগুলোতেও নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত চাল রয়েছে। দাম বাড়ার কোনো যুক্তি দেখছি না। তিনি বলেন, কিছু ব্যবসায়ী সরকারকে চাপে ফেলার জন্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করব। সিন্ডিকেটকে ছাড় দেওয়া হবে না। অন্য তদারকি সংস্থাগুলোর প্রতিও অনুরোধ, তারা যেন চালের বাজারে নজরদারি বাড়ায়।