ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৪:৪৬:৫৮ পিএম

গ্যাস সংকট কাটাতে স্থায়ী টার্মিনালের পরিকল্পনা

৪ জানুয়ারি, ২০২৫ | ১১:৫৯ পিএম

গ্যাস সংকট কাটাতে স্থায়ী টার্মিনালের পরিকল্পনা

ছবি: সংগ্রহ

রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য মহেশখালীতে এক্সিলারেট এনার্জি পরিচালিত ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) বন্ধ রয়েছে গত বুধবার থেকে। নেই দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহ বাড়ারও কোনো সুখবর। এতে করে দেশে আবাসিকের পাশাপাশি শিল্পখাতও ধুঁকছে তীব্র গ্যাস সংকটে।

 

যদিও সম্প্রতি চাহিদা মেটাতে বাড়তি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির পরিকল্পনা করে অন্তর্বর্তী সরকার। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আমদানি নীতি পরিবর্তনেরও। আমদানির জন্য অনুমোদনের অপেক্ষায় নতুন আরও অন্তত: ৩৩টি কোম্পানি। কিন্তু টার্মিনাল সক্ষমতা না থাকলে এই পরিকল্পনা কিছুতেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে সহসাই গ্যাস সংকট কাটবে না বলেও মত তাদের।

 

তবে ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের নানামুখী জটিলতা থাকায় সংকট কাটাতে স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ হলেও এতে করে দেশের গ্যাস খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস খাত চলছে রেশনিং (এক খাতে সরবরাহ কমিয়ে অন্য খাতে দেওয়া) করে। দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কোনো কারণে সরবরাহ এর চেয়ে কমলেই বেড়ে যায় সংকট।

 

দেশীয় এবং আমদানি উৎস থেকে বর্তমানে সারাদেশে দৈনিক সরবরাহ হচ্ছিল ২৭১ কোটি ঘনফুট গ্যাস। আর দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। বাকিটা আমদানিকৃত এলএনজি থেকে সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু গত বুধবার রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য মহেশখালীর এক্সিলারেট এনার্জি পরিচালিত এফএসআরইউটি বন্ধ রয়েছে।

 

তিনদিন চলবে সংস্কার কাজ। অপর একটি এফএসআরইউ দিয়ে দৈনিক ৫৭ থেকে ৫৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। এর ফলে দৈনিক ১৫ থেকে ১৮ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে। অন্যান্য খাতেও দৈনিক প্রায় ৫ থেকে ৭ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া শীতে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় পাইপলাইনে তরল পদার্থ জমে গ্যাস প্রবাহের চাপ কমে যায়। সব মিলিয়ে চাহিদার তুলনায় সংকট হচ্ছে প্রায় ১শ’ কোটি ঘনফুট গ্যাসের। ফলে শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আবাসিক খাতেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের।

 

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বার্ষিক ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন এলএনজি সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালে কাতারের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ। ১৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহের ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ কম খরচে জ্বালানির বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গত দুই বছর ওমান, ব্রুনাই, সৌদি আরবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে ব্যাহত হয় আমদানি। উপরন্তু এলএনজি টার্মিনালের সক্ষমতাও একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এই সংকট থেকে উত্তরণে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশীয় কূপ খননে জোর দেওয়ার পাশাপাশি আমদানি বাড়াতেও নেওয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ।

 

ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল পরিচালনায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে স্বীকার করে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, এসব টার্মিনাল বছরে অন্তত: একবার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাঠাতে হয়। এ ছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাসেও এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে গ্যাস সরবরাহে বিঘœ ঘটে। তাই আমরা স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছি। আশা করছি এ বছরেই স্থানীয় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হবে। সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় এর সুফল ঠিক কবে নাগাদ পাওয়া যাবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে গ্রাহকদের ভোগান্তি কমাতে সরকার অবশ্যই এটি করবে।

 

এদিকে স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পাশাপাশি আমদানি বাড়াতেও সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানান উদ্যোগ। বাড়ানো হচ্ছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। প্রতিযোগিতা বাড়াতে অর্থাৎ সর্বনি¤œ দর পেতে আরও ৩৩ কোম্পানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমদানির অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, যেহেতু দেশীয় কূপগুলোতে এখনো নতুন করে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না তাই প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে আমাদের আমদানিই করতে হবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি এক্ষেত্রে যেন সর্বনি¤œ দামে পাওয়া যায়।

 
আপনারা জানেন, স্পট মার্কেট বা খোলাবাজার থেকে এলএনজি ক্রয়ে বিগত সরকারের বদান্যতায় ভিটোল, গানভর, এক্সিলারেট এনার্জি, সামিটসহ গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে আমদানির প্রক্রিয়া জিম্মি ছিল। আমরা সেই প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে এখন উন্মুক্ত দর প্রস্তাবের মাধ্যমে আমদানিকারকের পরিমাণ বাড়াতে চাইছি। ইতোমধ্যে এলএনজি সরবরাহের জন্য আরামকো, শেল, বিপি’র মতো জ্বালানিখাতের ৩৩টি জায়ান্ট কোম্পানি আবেদন করেছে। উন্মুক্ত দরপত্রের এটাই সবচেয়ে বড় সুবিধা। আমরা আরও উন্মুক্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরবরাহকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে আরও খরচ বাঁচাতে চাই।

 

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা (বা ৫০৪ মিলিয়ন ডলার) এর এলএনজি আমদানি করে। বেশিরভাগটাই প্রয়োজন হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানির জন্য।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, বর্তমানে কাতার থেকে বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৭ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। কাতারের রাশ লাফান লিক্যুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ওই চুক্তির আওতায় বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। সাইড লেটার চুক্তির মাধ্যমে ২০২২ সালে এর অতিরিক্ত হিসেবে বছরে আরও ১ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় এর আগে প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু কাতার তাতে সাড়া দেয়নি।

 

গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে হলে হয় উৎপাদন বাড়াতে হবে অথবা আমদানি বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে আমদানি বাড়ানো কঠিন কারণ বাংলাদেশ এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলার সংকটে আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে গ্যাসের প্রকৃত মজুত কত, নতুন গ্যাস কূপ খনন কবে সম্ভব হবে তা নিশ্চিত নয়। এই কাজে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এবং রাশিয়ার প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম নিয়োজিত আছে। তাই আমদানির ক্ষেত্রে নতুন কোম্পানি যোগ হলে তুলনামূলক কম মূল্যে গ্যাস পাওয়া যাবে জানিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বতর্মান সরকার বিগত সরকারের আমলে হওয়া গলা পর্যন্ত হওয়া দুর্নীতির খেসারত দিচ্ছে।

 

ইচ্ছে করলেই সেই গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নিজেদের আখের গোছাতে তাদের পছন্দমতো কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করত। এবার যেহেতু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন কোম্পানি আসছে সেহেতু আমদানি করা এলএনজির মূল্য কম হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে আমি মনে করি।

এদিকে শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই রাজধানীর আবাসিকখাতে গ্যাসের সরবরাহ কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। গত দুই দিন থেকে যা তীব্র আকার ধারণ করেছে। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ফার্মগেট, কলাবাগান, ধানম-িসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা গ্যাসের চাপ কম থাকার কারণে ঠিকমতো চুলায় রান্না করতে পারছেন না। তাই বিগত সরকারের মতো বর্তমান সরকারকেও এর জন্য দায়ী করে দোষারোপ করছেন তারা। এমনই একজন রাজধানীর বাসাবো বৌদ্ধমন্দির এলাকার বাসিন্দা সাইফ বাবলু।


তিনি বলেন, শীত না আসতেই গ্যাসের এই বেহাল অবস্থা। সকাল ৯টা চুলায় আধাকেজি চালের ভাত রান্না করার জন্য বসানো হয়েছিল। বেলা ১১টা ৩০ এ বহু কষ্টে রান্না হয়েছে।’
একই রকম অভিযোগ করেন রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা শান্তা ইসলামেরও। তিনি বলেন, এখনো শীত তেমন করে না পড়লে কি হবে গ্যাসের চুলায় আগুন কমে গেছে আরও আগেই। চুলায় আগুনের চাপ না থাকায় দিনের রুটিনও বদলে গেছে। সকালের রান্না দুপুরে করতে হয়। দুপুরের রান্না রাতে। সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু জনগণের দুর্ভোগ কি কমে?

 

কমেছে শিল্প উৎপাদনও ॥ গ্যাস সংকটে দেশের বড় শিল্প কারখানাগুলোতে কমেছে উৎপাদন। বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে তৈরি পোশাক শিল্প। এই খাতে গড়ে উৎপাদন কমেছে শতকরা ২০-৩০ ভাগ। আবার যারা ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্যবহার করছেন তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। বাজার থেকে চড়া দামে জ্বালানি তেল কিনতে হচ্ছে তাদের। উৎপাদন কমে যাওয়া ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ে ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।

 

বিকেএমইএ এর সহ সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে আমার কারখানায় উৎপাদন ৫০ ভাগের নিচে নেমে এসেছে। কারণ গ্যাস না থাকার কারণে ডায়িং ফ্যাক্টরিগুলো সময় মতো এবং চাহিদা মতো ফেব্রিক সরবরাহ করতে পারছে না। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এখন তার ক্যাপাসিটির ৫০ ভাগের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না।

 

বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, গ্যাসের সঙ্গে ডলার সংকট এবং ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় আমরা সংকটে আছি। যেসব কারখানা পুরোপুরি গ্যাসের ওপর নির্ভশীল তাদের উৎপাদন কমে গেছে। আর যাদের ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। বাজার থেকে উচ্চ মূল্যে জ্বালানি তেল কিনে তাদের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। আর সব মিলিয়ে উৎপাদন র্কমে যাচ্ছে।

গ্যাস সংকট কাটাতে স্থায়ী টার্মিনালের পরিকল্পনা