ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৮:১২:৩৮ এএম

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহার হচ্ছে সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ

১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৯:০ পিএম

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহার হচ্ছে সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ

ছবি: সংগ্রহ

দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বিবেচনায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সবচেয়ে বেশি সাশ্রয়ী। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) হিসাব অনুযায়ী, এ ধরনের কেন্দ্রের বর্তমান স্থাপিত সক্ষমতা ১২ হাজার ৩৩৩ মেগাওয়াট। যদিও ব্যবহার করা যাচ্ছে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত, যা মোট সক্ষমতার কেবল ৪০ শতাংশ। গ্যাস সংকটের কারণে বড় সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকেও এখন পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না।


পেট্রোবাংলার ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির আওতায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে মোট ৭১টি। এর মধ্যে গত বুধবার ৩৪টি কেন্দ্র জ্বালানি সরবরাহ পেয়েছে বলে প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। সে হিসাবে বাকি ৩৭ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ ছিল। গ্যাসের প্রয়োজনীয় জোগান না থাকায় বিপিডিবির ১ হাজার ৩১৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে গ্যাসভিত্তিক সামিট ও ইউনিক গ্রুপের উচ্চ সক্ষমতার দুটি কেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ গ্যাস সরবরাহ করা গেলে এসব কেন্দ্র থেকে কম মূল্যে যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, তেমনি বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেয়ার মতো আর্থিক জটিলতাও কমানো যেত বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।


বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে হলে দৈনিক ২ হাজার ৪২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। কিন্তু সংকটের কারণে সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর সুযোগ নেই। আবার বিপিডিবির দৈনিক জ্বালানিভিত্তিক (মেরিট ডিসপ্যাচ অর্ডার) বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে গ্যাসের প্রয়োজন অন্তত ১ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু পেট্রোবাংলা থেকে বিদ্যুতে গ্যাসের বরাদ্দ রয়েছে গড়ে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। তা দিয়েই গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোকে রেশনিং করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে বিপিডিবিকে। এতে কখনো সরকারি, কখনো বা বেসরকারি বড় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

 

জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে কম ব্যবহারের কারণ মূলত গ্যাস সংকট। এগুলো চালানো গেলে বিপিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক কমানো সম্ভব ছিল। কিন্তু সেটা করা যাচ্ছে না। বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক যতগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে সেগুলো অনেক এফিশিয়েন্ট। গ্যাস পাওয়া গেলে এগুলোর সব ব্যবহার করার সুযোগ ছিল।’

 

পেট্রোবাংলার গত বুধবারের গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গ্যাস সংকটের কারণে বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) আওতাধীন ২০টি কেন্দ্রের মধ্যে চালু ছিল কেবল নয়টি। ২০টি কেন্দ্রে ৯৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ পেয়েছে ২৬৯ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্যাস পেয়েছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে অবস্থিত রিলায়েন্স পাওয়ার। ৭১৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটির জন্য দেয়া হয়েছে ৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট। গত ৬ ডিসেম্বর থেকে এটি পরীক্ষামূলকভাবে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিচ্ছে। তবে গ্যাসের জোগান সীমিত থাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদন এখনো শুরু করতে পারেনি বিপিডিবি।

 

তিতাসের আওতাধীন ঘোড়াশালে বিপিডিবির ১ হাজার ৩১৫ (চারটি ইউনিট) মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। ৫৮৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার সামিট মেঘনাঘাট-২ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ারের ৫৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ মোট ১১টি কেন্দ্রও গ্যাস সংকটে বন্ধ রাখা হয়েছে।

 

দেশের আরেকটি গ্যাস বিতরণকারী সংস্থা বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির আওতায় রয়েছে ১৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এগুলোর মোট সক্ষমতা ২ হাজার ৭৫৪ মেগাওয়াট। কেন্দ্রগুলোর গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৪২৩ মিলিয়ন ঘনফুট। অথচ সেখানে সরবরাহ দেয়া যাচ্ছে কেবল ১০৪ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাস সংকটের কারণে আটটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। তবে বাখরাবাদের আওতাধীন আশুগঞ্জের ২২৫ মেগাওয়াট, ইউনাইটেড পাওয়ারের ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্র দুটি সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছে।

 

চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত রয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। কোম্পানিটির আওতায় ৯২২ মেগাওয়াটের পাঁচটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের রাউজানে ২১০ মেগাওয়াট সক্ষমতার দুটি ইউনিটে ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া হয়েছে। ইউনিট দুটির গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন ৯৫ মিলিয়ন ঘনফুট।

 

তিতাস ও বাখরাবাদের মতো দেশের আরেক বিতরণ কোম্পানি জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমস লিমিটেডের (জেজিডিডিসিএল) আওতায় রয়েছে ১৯টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যেগুলোর মোট সক্ষমতা ২ হাজার ৪৫৯ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্রে প্রতিদিন ৩৯৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও গত বুধবার চালু থাকা ১০টিতে গ্যাস দেয়া হয়েছে ১৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সরবরাহ পেয়েছে সিলেটের বিবিয়ানা ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কেন্দ্রটির চাহিদা ৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট থাকলেও ওইদিন সরবরাহ দেয়া হয়েছে প্রায় ৫৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এছাড়া শাহজীবাজার ৩০ মেগাওয়াট সক্ষমতার দুটি ইউনিটে ১৭ মিলিয়ন ঘনফুট, সিলেটের কুমারগাঁও ১৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৩৬ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ দেয়া হয়েছে।

 

দেশের পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত রয়েছে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল)। বিতরণ কোম্পানিটির আওতায় মোট আটটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলেও বুধবার চালু ছিল মাত্র একটি। বাকিগুলোকে গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ রাখতে হয়। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এনডব্লিউপিজিসিএল) গ্যাসভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শুধু গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।

 

দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত রয়েছে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিসিএল)। কোম্পানিটির আওতায় মোট ৯৩৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার পাঁচটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে গ্যাস সরবরাহ সাপেক্ষে চালু ছিল কেবল তিনটি কেন্দ্র। দ্বীপ জেলা ভোলায় ২২৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ দেয়া হয় ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট এবং কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ৩৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র পায় ৪২ মিলিয়ন ঘনফুট।

 

দেশে গ্যাসের সংকট দীর্ঘদিনের। স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন ও আমদানি করা এলএনজি মিলিয়ে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে মোট ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। এর মধ্যে শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে গড়ে ৮০০ থেকে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। বর্তমানে এর বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় গ্যাসের জোগান দেয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার শীর্ষ কর্মকর্তারা। কারণ বর্তমানে শিল্প ও সার কারখানায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাসের সরবরাহ দেয়া হচ্ছে।

 

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, ‘শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। যে কারণে এ খাতে গ্যাসের চাহিদাও কিছুটা কমে যায়। তবে পেট্রোবাংলা বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গড়ে প্রতিদিন ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দিচ্ছে। গ্যাসের প্রাপ্যতা অনুযায়ী, এর চেয়ে বেশি বিদ্যুতে বরাদ্দ দেয়া এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। তবে এখন শিল্পে গ্যাসের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। সেখানে এখন গ্যাসের সংকট অনেকটাই কমে গেছে। এছাড়া সার উৎপাদনে আগামী পাঁচ মাস গ্যাস সরবরাহ বেশি থাকবে। সারের সংকট যাতে না হয়, সেজন্য সেখানে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে।’

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ব্যবহার হচ্ছে সক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ