ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
২০ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ১১:৪ এএম
অনলাইন সংস্করণ
চুক্তি লঙ্ঘন করে কর ছাড় সুবিধা গোপন আদানির !
২০ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ১১:৪ এএম
![চুক্তি লঙ্ঘন করে কর ছাড় সুবিধা গোপন আদানির !](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2024/12/20/20241220110402_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে আদানি পাওয়ারের বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ওই বিদ্যুৎ চুক্তির আওতায় ঝাড়খণ্ডের গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ২০১৯ সালে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ঘোষণা করে মোদি সরকার। এতে যন্ত্রপাতি আমদানিসহ নির্মাণব্যয়ের ওপর বড় ধরনের কর ছাড় সুবিধা পেয়েছে। তবে চুক্তির দুর্বলতায় সে সুবিধার ভাগ বাংলাদেশ পায়নি। এদিকে এসইজেড হওয়ায় আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হচ্ছে না আদানিকে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালন ব্যয় কমে গেছে। চুক্তি অনুযায়ী, সেটি বাংলাদেশকে জানানো ও বিদ্যুতের দাম কমানোর কথা ছিল। তবে তা বাংলাদেশকে জানায়নি আদানি। আবার বিদ্যুতের দামও কম রাখছে না কোম্পানিটি। সেই সুবিধার তথ্য গোপন করে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম শূন্য ৩৫ সেন্ট বা ৪২ পয়সা বেশি নিচ্ছে আদানি।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ২০১৭ সালে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই এ চুক্তি অনুমোদন করেছিলেন। আর চুক্তিটিও বাংলাদেশের অন্যান্য কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয়বহুল। চুক্তির সুযোগে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য কয়লার দাম ৩০ শতাংশ বেশি চাচ্ছে আদানি। তাই এ বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে নতুন করে দর কষাকষি করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
২০২৩-২৪ অর্থবছর পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ে ১১ টাকা ৮৬ পয়সা। এর মধ্যে জ্বালানি ব্যয় ছিল ছয় টাকা ১১ পয়সা। আর আদানির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ে ১৪ টাকা ৮৩ পয়সা, যার মধ্যে জ্বালানি ব্যয় ছিল সাত টাকা ৫৭ পয়সা। অর্থাৎ আদানির বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির বাড়তি ব্যয় করতে হয়েছে প্রতি ইউনিটে দুই টাকা ৯৭ পয়সা, যার মধ্যে বাড়তি জ্বালানি ব্যয় ছিল এক টাকা ৪৬ পয়সা। যদিও গত জুন থেকে কয়লার দাম আরও বাড়িয়ে দিয়েছে আদানি।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম রয়টার্স জানিয়েছে, আদানির সঙ্গে হওয়া মূল বিদ্যুৎ চুক্তির সঙ্গে ছিল আরেকটি বাড়তি বাস্তবায়ন চুক্তি। সেই চুক্তিতে কর সুবিধা হস্তান্তর বা ভাগাভাগির শর্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ার ও পিডিবির মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি এবং বাস্তবায়ন চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কর-সংক্রান্ত সুবিধার পরিবর্তন দ্রুত বাংলাদেশকে জানানো এবং সেই সুবিধা বাংলাদেশকেও দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু এ সুবিধার কথা জানানো কিংবা সুবিধা ভাগাভাগি কোনোটাই করেনি আদানি পাওয়ার।
২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এবং ২২ অক্টোবর আদানিকে পাঠানো পিডিবির চিঠি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। চিঠিগুলোর কপি রয়টার্সের হাতে এসেছে। ওই চিঠিগুলোতে বাংলাদেশকে এসব সুবিধা দিতে অনুরোধ করা হয়েছে কোম্পানিটিকে। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম না প্রকাশের শর্তে পিডিবির দুজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, তারা আদানি পাওয়ারের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাননি। তবে কর সুবিধা হস্তান্তর করা হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে বাংলাদেশের প্রায় ০.৩৫ সেন্ট ব্যয় সাশ্রয় হতো।
বাংলাদেশ সরকারের একটি নথির তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৮.১৬ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। এই হিসাবে বাংলাদেশের মোট সাশ্রয় হতে পারত প্রায় ২৮.৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা বিল তারা বেশি নিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এ প্রসঙ্গে জানান, ভবিষ্যতে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে আলোচনার সময় এই ব্যয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে।
জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আদানির সঙ্গে চুক্তিতে অনেকগুলো দুর্বলতা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম দুর্বলতা হলো, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাণিজ্যিকভাবে চালুর আগে (সিওডি) কোনো ধরনের কর অবকাশ পেলে তার অংশ বাংলাদেশকে দেবে না। ফলে এসইজেড ঘোষণায় আদানি পাওয়ার শুল্কমুক্ত যন্ত্রপাতি আমদানির সুযোগ পেলেও তার ছাড় বাংলাদেশ দেয়া হয়নি। তবে সিওডির পরে বর্তমানে তারা ৩০ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স মওকুফ পাচ্ছে। এটি তারা সমন্বয় করেনি, যার জন্য আদানিকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র তৈরির জন্য গঠিত কমিটি ড. ইউনূসের কাছে জমা দেয়া প্রতিবেদনে বলেছে, আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে আনা অভিযোগের কারণে বাংলাদেশেরও এই বিদ্যুৎ চুক্তি ‘যাচাই’ করা উচিত। চুক্তিটি ‘তড়িঘড়ি’ করে করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি রয়টার্স। তবে হাসিনার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে বলেন, আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তি সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না, তবে তিনি নিশ্চিত যে ‘এতে কোনো দুর্নীতি হয়নি’। আদানির চুক্তিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগের জবাবে জয় বলেন, ‘আমি কেবল ধারণা করতে পারি, এই চুক্তির জন্য ভারত সরকার লবিং করেছে’। তবে মোদি প্রশাসন ও ভারত সরকারের অন্য কর্মকর্তারা এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে পাওনা পরিশোধ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বিরোধের জেরে ৩১ অক্টোবর আদানি পাওয়ার গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে আনে। এর আগে ১ জুলাই এক চিঠিতে কয়লার দামের ওপর পিডিবি ছাড়ের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ করে আদানি পাওয়ারকে। কোম্পানিটি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। আদানি মে মাস পর্যন্ত পিডিবিকে যে ছাড় দিয়েছিল, তাতে প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়। তবে আদানি জানায়, পাওনা মেটানোর আগে তারা কোনো নতুন ছাড় বিবেচনা করবে না।
আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসার কয়েক মাস আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম কয়লার দাম নিয়ে আপত্তি তোলে পিডিবি। সে সময় আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়ে কয়লার দাম প্রায় দ্বিগুণ চেয়েছিল আদানি। তবে ওই দামে বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবি রাজি না হওয়ায় তারা দাম কিছুটা কমাতে রাজি হয়। এক্ষেত্রে পায়রা, রামপাল ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্রয়কৃত কয়লার দামের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যের চেয়ে দশমিক ০১ (০.০১) সেন্ট কম নেয়ার কথা জানায় কোম্পানিটি।
এক বছরের জন্য এ মূল্য রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল আদানি, যা গত মে মাসে শেষ হয়েছে। সে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পিডিবির পক্ষ থেকে কয়লার দাম পর্যালোচনায় আদানিকে চিঠি দেয়া হলেও তারা বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক নয়। পিডিবি সূত্র বলছে, পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম নিচ্ছে ৭৫ মার্কিন ডলার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এসএস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম ৮০ ডলারের কম। আর আদানি প্রতি টন কয়লার দাম চাইছে ৯৬ ডলার। তার মানে প্রতি টন কয়লায় রামপাল ও পায়রার ১৬ ও ২১ ডলার বাড়তি চাইছে তারা।
যদিও চুক্তিতেই বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়েছে আদানিকে। কয়লা আমদানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে ঘোষিত দামের আড়ালে বিশেষ ছাড় থাকে। কয়লা কেনার সময় সমঝোতার ওপর ছাড়ের বিষয়টি নির্ভর করে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লা কেনে বিশেষ ছাড়ে। বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির কর্মকর্তারা বলেন, অন্য সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা কেনার বিল ধরেই খরচ হিসাব করা হয়। তবে আদানির সঙ্গে পিডিবির চুক্তি অনুসারে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার সূচকের (কোল ইনডেক্স) গড় করে মূল্য হিসাব করা হবে। গড় দাম ধরার কারণে আদানির বিলে বাড়তি দাম আসছে।
এছাড়া আদানি বিশেষ ছাড়ে কয়লা কিনলেও সেই সুবিধা পাবে না পিডিবি। এদিকে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে পুরোদ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলেও আদানি পাওয়ারের বিল পুরোটা পরিশোধ করেনি বাংলাদেশ। গত মার্চ পর্যন্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছে। সরবরাহকৃত বিদ্যুতের বিল বাবদ বাংলাদেশের কাছে কয়েকশ’ মিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে আদানির। তবে পাওনার সঠিক অঙ্ক নিয়ে দুই পক্ষের মতবিরোধ রয়েছে। আবার বকেয়া বাড়তে থাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে আদানি। বর্তমানে সক্ষমতার অর্ধেক বা তারও কম সরবরাহ করছে আদানি।
পিডিবি বলছে, দেরিতে বিল পরিশোধের জন্য বছরে ১৫ শতাংশের সুদ ধরা আছে আদানির চুক্তিতে, যা অন্য কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রে নেই। এতে চুক্তির শর্তে পিডিবি বিল পরিশোধ করলে তা থেকে বকেয়া বিলের সুদ বাদ দিয়ে তারপর বিদ্যুৎ বিল সমন্বয় করে আদানি। এতে আদানি পাওয়ার দাবি করছে, বাংলাদেশের কাছে তাদের পাওনার পরিমাণ ৯০০ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পিডিবি বলছে, এই পাওনার পরিমাণ প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলার। ডলার সংকটে ভুগতে থাকা বাংলাদেশ বকেয়া পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা জোগাড় করতে পারেনি বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন পিডিবি কর্মকর্তারা।
আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়ায় বাংলাদেশ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ প্রসঙ্গে রয়টার্সকে বলেছেন, আদানির সরবরাহ ছাড়াই স্থানীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোই দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু না থাকলেও স্থানীয় উৎপাদনই পর্যাপ্ত বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে আদানির চুক্তি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন ও তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির জানিয়েছেন, আদালতের নির্দেশ দেয়া তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবে। তিনি বলেন, ‘যদি প্রমাণিত হয় যে, চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে ঘুষ আদান-প্রদান বা অনিয়ম হয়েছে, সেক্ষেত্রে চুক্তি বাতিলের ঘটনা ঘটলে আদালতের আদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’
![চুক্তি লঙ্ঘন করে কর ছাড় সুবিধা গোপন আদানির !](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)