ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১০:৩৫ এএম
অনলাইন সংস্করণ
দামে ঊর্ধ্বমুখী এলএনজি দিয়ে লোডশেডিং কমানোর পরিকল্পনা সরকারের
১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১০:৩৫ এএম
ছবি: সংগ্রহ
আন্তর্জাতিক বাজারে গত আট মাসে কয়লার দাম কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। একই সময়ে স্পট মার্কেটে প্রায় ১৮ শতাংশ বেড়েছে এলএনজির দাম। অথচ আসন্ন রমজানে ঊর্ধ্বমুখী জ্বালানিটি দিয়েই বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলার পরিকল্পনা করছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। তাই অতিরিক্ত এলএনজি কার্গো কিনে রাখতে চায় সরকার।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন রমজানে বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হবে ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এ সময় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় গ্যাস সরবরাহ দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে দিনে ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে দৈনিক ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। অতিরিক্ত ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হবে এলএনজি আমদানি করে। এ কারণে শুধু রমজানের জন্য বাড়তি চার কার্গো এলএনজি কেনার অতিরিক্ত প্রাক্কলন করেছে জ্বালানি বিভাগ।
রমজানের পাশাপাশি গ্রীষ্ম মৌসুমেও বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নানা পরিকল্পনা করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর পরও দৈনিক ৭০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে বলে ৫ ফেব্রুয়ারি এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। মূলত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে দিয়ে ঘাটতি মোকাবেলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এজন্য গ্যাস সরবরাহ ঠিক রাখতে এলএনজি আমদানি বাড়াতে যাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানি কয়লার দাম নিম্নমুখী থাকা সত্ত্বেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দেয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, বিগত সরকারও বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় এলএনজিকে গুরুত্ব দিয়েছিল। যদিও একপর্যায়ে দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে পণ্যটির আমদানি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় আকারে ঘাটতি তৈরি হয়। দেশজুড়ে লোডশেডিংয়ের মাত্রাও ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। এমন অভিজ্ঞতার পরও বিদ্যুতে ঊর্ধ্বমুখী দামের জ্বালানি পণ্যের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) আর্থিক চাপ—দুটোই বেড়ে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘শুধু যে এলএনজি আমদানি করে লোডশেডিং কমানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। কয়লা ও গ্যাস দুটো পণ্যই আমদানি করা হবে। তবে রমজানে বিদ্যুতের চাহিদার প্রাক্কলন যেহেতু বেশি রয়েছে, আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবেলার চেষ্টায় আর গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে; সে কারণে বাড়তি এলএনজি কার্গো আমদানি করা হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কয়লা ও এলএনজি দুটো পণ্যই আমদানি করতে হবে। লজিস্টিকস সাপোর্টের বিষয়টি চিন্তা করলে কয়লার চেয়ে এলএনজি বেটার। আমাদের লক্ষ্য জ্বালানির জোগানটা নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন সাশ্রয়ী করা।’
কয়লার আন্তর্জাতিক বাজার এখন নিম্নমুখী। গত আট মাসে টনপ্রতি এ জীবাশ্ম জ্বালানিটির দাম কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। নিউ ক্যাসল কোল ইনডেক্স অনুযায়ী, গত বছরের অক্টোবরে কয়লার টনপ্রতি মূল্য ছিল ১৪৮ ডলার। সেখানে গতকাল কয়লার দাম ওঠানামা করছিল প্রতি টন ১০৭ ডলারের আশপাশে। জানুয়ারিতে তা ছিল ১২২ ডলারে। এর আগের চার মাসে কয়লার টনপ্রতি দাম ছিল ডিসেম্বরে ১৩৩ ডলার, নভেম্বরে ১৪১, অক্টোবরে ১৪৮ ও সেপ্টেম্বরে ১৪১ ডলার।
একই সময় আবার স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম ক্রমেই বেড়েছে। গত আট মাসে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের জুলাইয়ে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল (এমএমবিটিইউ) এলএনজির দাম যেখানে ১২ ডলার ৫২ সেন্ট ছিল, গতকাল তা ১৪ ডলার ৭২ সেন্টে উঠেছে। সামনে এ দাম আরো ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা ও পূর্বাভাস দিচ্ছে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটসের তথ্য অনুযায়ী, ৬ ফেব্রুয়ারি প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ছিল ১৪ ডলার ৪৯ সেন্ট, যা জানুয়ারির একই সময়ে ছিল ১৪ ডলার ৪৪ সেন্টে। গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১৪ ডলার ২৪ সেন্ট, নভেম্বরে ১৪ ডলার ৯২, অক্টোবরে ১৩ ডলার ৭৯, সেপ্টেম্বরে ১৩ ডলার ৮২, আগস্টে ১৪ ডলার ও জুলাইয়ে ছিল ১২ ডলার ৫২ সেন্ট।
দেশে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বড় পাঁচটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে রয়েছে, যেগুলোর মোট সক্ষমতা ৬ হাজার ৭৮৭ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেক সক্ষমতাই জ্বালানি সংকটের কারণে ব্যবহার করা যায় না। শীত মৌসুমে এসব কেন্দ্রের উৎপাদন নেমে আসে দুই-আড়াই হাজার মেগাওয়াটে। তবে এবার কেন্দ্রগুলোর সিংহভাগ চালানোর কথা বিপিডিবির পক্ষ থেকে বলা হলেও তা আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
এ বিষয়ে বিপিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে কথা বলতে যোগাযোগ করেও পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সংস্থটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গ্রীষ্মে অন্তত পাঁচ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে বিপিডিবির। তবে বিষয়টি নির্ভর করছে অর্থের ওপর। প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া গেলে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালানো হবে। পায়রায় দুটি ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্রীষ্ম মৌসুমে চালানো হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে।’
রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য আগামী জুনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ৪ বিলিয়ন ডলার চেয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ ৩ বিলিয়ন ডলার এবং বাকি অর্থ জ্বালানি আমদানি, অর্থাৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েল ও গ্যাস আমদানির জন্য। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহের অনুরোধ জোনানো হয়েছে। ৩ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বৈঠক করেন। সেখানেই এ অর্থ চাওয়া হয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, ‘এলএনজির দাম বিশ্ববাজারে বরাবরই অস্থিতিশীল। এমন ধরনের জ্বালানিকে ঘিরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখার পরিকল্পনা চ্যালেঞ্জিং। বরং মূল্যসাশ্রয়ী জ্বালানিকে ঘিরেই বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনা করা উচিত। এখন কয়লার দাম কম, এগুলো বেজ লোড বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ফলে এসব কেন্দ্রের জ্বালানি নিশ্চিত করে কীভাবে সার্বক্ষণিক চালানো যায় সে পরিকল্পনা দরকার। কারণ এগুলো বসিয়ে রাখলে ব্যয় কমাতে পারবে না বিপিডিবি।’