ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৭:০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ২ বিলিয়নেরও বেশি কমাচ্ছে আইএমএফ
২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৭:০ পিএম
![বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ২ বিলিয়নেরও বেশি কমাচ্ছে আইএমএফ](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2024/12/27/20241227120546_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পর্ষদে গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এ ঋণের বিনিময়ে বেশকিছু সংস্কার বাস্তবায়নের পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রা ও মানদণ্ড পরিপালন করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হচ্ছে নিট বৈদেশিক রিজার্ভ। তবে ঋণ অনুমোদনের পর থেকে টানা পাঁচ প্রান্তিকে বাংলাদেশ রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। কেবল এ বছরের জুন ও সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সে লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
রিজার্ভ নিয়ে এ টানাপড়েনের মধ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া আইএমএফ মিশন আগামী বছরের জুনে রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমাতে রাজি হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে সংস্থাটির পর্ষদে ঋণের কিস্তি ছাড় অনুমোদনের সময় এ বিষয়টিও চূড়ান্ত হবে বলে জানা গেছে।
ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন পর্যালোচনার জন্য গত ৩-১৮ ডিসেম্বর আইএমএফের গবেষণা শাখার উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে একটি মিশন বাংলাদেশ সফর করে। এ সময় বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ ও আইএমএফের কর্মকর্তাদের মধ্যে ঋণ কর্মসূচির অধীনে বিভিন্ন শর্ত, সংস্কার ও লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সামনের বছরে মার্চ ও জুন প্রান্তিকে নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়েছে সংস্থাটি। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে ১৬ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হবে। যেখানে এর আগে এ সময়ে ১৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। আগামী বছরের জুন শেষে নিট রিজার্ভ সংরক্ষণে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে ১৭ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগে ছিল ১৯ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা কমছে ২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।
আইএমএফের পর্ষদে বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে। এরপর ফেব্রুয়ারি ঋণের প্রথম কিস্তির টাকা পায় বাংলাদেশ। একই বছরের মার্চ শেষে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ২২ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিল সংস্থাটি। যদিও ওই সময়ে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল ১৯ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের জুনে ২৩ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংরক্ষণ হয়েছে ১৯ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারায় আইএমএফের কাছে ছাড় চেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ১৭ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে ১৬ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ডিসেম্বরে ১৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল আইএমএফ। যদিও এ সময়ে বাংলাদেশ সংরক্ষণ করতে পেরেছে ১৬ দশমিক ৭৩ ডলার এবং এজন্য আইএমএফের কাছে ছাড় চাইতে হয়েছে।
চলতি বছরের মার্চ শেষে আইএমএফের বেঁধে দেয়া ১৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে দেশের প্রকৃত নিট রিজার্ভ ছিল ১৪ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। এর পরের মাসেই নিট রিজার্ভ এ যাবৎকালের সর্বনিম্ন ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। ২০২৪ সালের জুন শেষে ১৪ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১৬ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ১৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট রিজার্ভ ছিল ১৪ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, এ বছরের ডিসেম্বর শেষে ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত ২৪ ডিসেম্বর শেষে বিপিএম৬ পদ্ধতিতে দেশের গ্রস ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারে। আইএমএফের নিট রিজার্ভের শর্ত পূরণ করতে চলতি মাসের শুরু থেকেই বাজার থেকে ডলার কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আইএমএফের হিসাব অনুসারে নিট রিজার্ভ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিপিএম৬ পদ্ধতিতে গ্রস ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (জিআইআর) থেকে রিজার্ভ সম্পর্কিত দায় বাদ দিতে হয়। রিজার্ভ সম্পর্কিত দায়ের মধ্যে রয়েছে আইএমএফের কাছ থেকে নেয়া এসডিআর বরাদ্দ ও সংস্থাটির কাছে থাকা বাংলাদেশের এক বছরের কম মেয়াদের অনাদায়ী দায় এবং অন্যান্য বিদেশী মুদ্রার দায়, রূপান্তরযোগ্য মুদ্রায় অনিবাসীদের দায়, আকু, জাপান ডেবট রিলিফ গ্র্যান্ট (জেডিআরজি) ও বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা দায়, ফরওয়ার্ড কন্ট্রাক্টস, বিদেশী মুদ্রায় সোয়াপ এবং অন্যান্য ফিউচার মার্কেটের কন্ট্রাক্টস-সংক্রান্ত দায়ও এক্ষেত্রে বাদ যাবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির কাছ থেকে এ সময়ে অর্থ পাওয়া যাবে। বর্তমানে রেমিট্যান্স প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার বিক্রি করছে না। এ প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে রিজার্ভে তেমন ক্ষয় হবে না। চলতি ডিসেম্বরে বাড়তি অর্থ পরিশোধের যে চাপ দেখা যাচ্ছে সেটি সাময়িক মনে হচ্ছে। বাজারে ডলারের যে প্রবাহ রয়েছে সেটি দিয়েই এ চাপ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালে আমদানি কিছুটা বাড়বে। তবে যদি মুদ্রাবাজারে স্বচ্ছতা থাকে এবং নমনীয়তা বাড়ে তাহলে ১৭ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা খুব একটা কঠিন হবে বলে মনে হয় না।’
চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। জুলাই থেকে নভেম্বর—এ পাঁচ মাসে প্রবাসীরা ১১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। চলতি মাসের ২১ দিনে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে আর চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর—এ চার মাসে রফতানিতে ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
আইএমএফের সদ্যসমাপ্ত মিশনের পক্ষ থেকেও দেশের বিনিময় হারে আরো নমনীয়তা আনার মাধ্যমে বাজারভিত্তিক মুদ্রার দর নির্ধারণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। মিশন শেষে সংবাদ সম্মেলনে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, ‘ঋণ কর্মসূচি চলাকালে আমরা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধরনের ক্ষয় দেখেছি। এক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক পর্যায়ে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে ডলারের আনুষ্ঠানিক দরের সঙ্গে বাজারদরের সামান্য ব্যবধান রয়েছে। এটিকে আরো নমনীয় করতে একটি পদ্ধতি চালুর জন্য আমরা সহায়তা করব, যাতে করে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে না হয়।’ আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের পর্ষদে ঋণের কিস্তি ছাড়ের প্রস্তাব ওঠানোর ক্ষেত্রে বিনিময় নমনীয় করাসংক্রান্ত শর্ত পূরণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে আরো বেশি বাজারভিত্তিক করতে চাইছে। বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতিটিকে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে এ নীতির বিকল্প ভাবা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এ ঋণ পাবে বাংলাদেশ। ঋণের গড় সুদের হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২৬ সাল পর্যন্ত এ ঋণ কর্মসূচি চলাকালে বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। এবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরো বাড়তি ৭৫ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এতে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৩০ কোটি ডলারে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং গত বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ গত জুনে তৃতীয় কিস্তি বাবদ ১১৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার ছাড় করেছে সংস্থাটি। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত তিন কিস্তিতে ঋণের ২২৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। চতুর্থ কিস্তিতে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাবে বাংলাদেশ।
![বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা ২ বিলিয়নেরও বেশি কমাচ্ছে আইএমএফ](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)