ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
২৮ অক্টোবর, ২০২৪ | ৩:৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বারছে সুদের হার, চাপে দেশের দরিদ্র জনগোষ্টি
২৮ অক্টোবর, ২০২৪ | ৩:৯ পিএম
ছবি: সংগ্রহ
নতুন বছরের শুরুর দিকে দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশে উঠেছে। এই হার সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালের শেষে ছিল সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিলের বড় অংশই গ্রাহকদের সঞ্চয়। কারণ, গত জুলাই থেকে সরকারের ঋণের সুদহারের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে সাধারণ গ্রাহককে দেওয়া ব্যাংকঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে।উচ্চ সুদে নেয়া এ ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বড় ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন দেশের প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
আরও পড়ুন
নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির সনদ নিয়ে বর্তমানে দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৭৩১টি বেসরকারি ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান। এমআরএর বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছরের জুন শেষে দেশের সবচেয়ে বড় ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের মোট তহবিলের আকার ছিল ৩৭ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৮ হাজার ৯৭ কোটি টাকাই ছিল গ্রাহকের সঞ্চয়। ১৪ হাজার ৩৯ কোটি টাকা ছিল ব্র্যাকের ক্রমপুঞ্জীভূত উদ্বৃত্ত।
সে হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ব্র্যাকের মোট তহবিলের ৮৬ দশমিক ৭২ শতাংশই নিজস্ব উৎসের। বাকি ৪ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নিয়েছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্র্যাকের তহবিল ব্যয় ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। যদিও প্রতিষ্ঠানটির পোর্টফোলিও ইল্ড ছিল ২৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশের তহবিল থেকে সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করেছে তারা।
ঋণের সুদহার বাড়ায় ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহারও বাড়াচ্ছে। আবার তারল্যসংকটে পড়ে কোনো কোনো ব্যাংক উচ্চ সুদে আমানত নিচ্ছে, তারা এমনকি ১২ শতাংশ সুদেও তহবিল সংগ্রহ করছে। এদিকে আমানতের সুদহার বৃদ্ধির কারণে ঘরে রাখা টাকা ব্যাংকে জমা রাখার প্রবণতা বেড়েছে। তবে এখনো আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি। ফলে ব্যাংকে টাকার সংকট চলছেই।
গত বছরের শেষে আশার ক্রমপুঞ্জীভূত উদ্বৃত্ত ছিল ২১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটিতে জমা ছিল গ্রাহকের ৯ হাজার ৮৮১ কোটি টাকার সঞ্চয়। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে আশার নেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১২০ কোটি টাকা।
গত বছরের জুন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৭৩১টি। সারা দেশে এসব প্রতিষ্ঠানের ২৫ হাজার ৩৩৬টি শাখা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মরত রয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার জনবল। ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৮ লাখ। এ প্রতিষ্ঠানগুলো ২ লাখ ৪৯ হাজার ৩০২ কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করেছে।
এর মধ্যে আদায় করেছে ১ লাখ ৬৫ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার ঋণ। জুন পর্যন্ত ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় গ্রাহকদের সঞ্চয়ের স্থিতি ছিল ৬২ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। আর এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার ৪২১ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলেন, ঋণের সুদ হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সিলিং নির্ধারণ করে দেওয়ায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কাজ করছে না। ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি থাকায় অর্থের সরবরাহ বাড়ছে। এই প্রবণতা ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে। জুনে গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বিশ্লেষকরা বলেন, ঋণের সুদ হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সিলিং নির্ধারণ করে দেওয়ায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কাজ করছে
চলতি অক্টোবরেই এমআরএর নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। স্বল্প সুদের তহবিল থেকে সর্বোচ্চ সুদে দেশের বড় ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ প্রশ্নটি সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে করা দরকার। ক্ষুদ্র ঋণদাতা বড় প্রতিষ্ঠান আর ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল সংগ্রহ ব্যয় সমান নয়। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক বা অন্য উৎস থেকে ঋণ নিয়ে সেটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে থাকে। কিন্তু বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল যেহেতু নিজস্ব উৎসের, সেহেতু তারা আরো কম সুদে ঋণ দিতে পারে।
বৈষম্যবিরোধী সমাজ বিনির্মাণের কথা বলা হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ঋণের অর্থ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বৈষম্য হচ্ছে বলে মনে করেন ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলো প্রান্তিক মানুষের আমানত এনে বড় ঋণগ্রহীতাদের কম সুদে দিচ্ছে। এ ঋণগ্রহীতারা যদি কলকারখানা নির্মাণ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখত, তাহলে বৈষম্য কমত।
অর্থনীতিবিদ মঞ্জুর হোসেন বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিৎ হবে ঋণে সুদের সিলিং প্রত্যাহার করে অর্থের সরবরাহ কমিয়ে আনা। এটা করা না হলে ঋণের চাপ আরও বাড়বে। '
ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠাগুলো গ্রাহকদের সঞ্চয়ের বিপরীতে ৬ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধের কথা। কিন্তু দেশের শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটিই আমানতকারীদের নির্ধারিত হারে সুদ পরিশোধ করছে না। এক্ষেত্রে গত অর্থবছরে গড়ে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করেছে ব্র্যাক। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করেছে উদ্দীপন। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো ৩ শতাংশের বেশি সুদ পরিশোধ করেনি। সঞ্চয়ের বিপরীতে সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৭২ শতাংশ হারে সুদ দিয়েছে ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ।
এমআরএর পরিচালক (ফাইন্যান্স, ফান্ড ম্যানেজমেন্ট ও হিসাব বিভাগ) মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘ক্ষুদ্র ঋণের সুদহার কমানোর জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরোধিতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি হলো তাদের পরিচালন ব্যয় ১৭-২০ শতাংশ। এ কারণে তাদের পক্ষে ২৪ শতাংশের কম সুদে ঋণ বিতরণ সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো সঞ্চয়কারীদের সর্বনিম্ন ৬ শতাংশ সুদ দেয়ার কথা।
এ বিষয়ে চতুর্থ বৃহৎ ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান টিএমএসএসের প্রতিষ্ঠাতা ড. হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘তারল্য সংকটের কারণে গত এক বছরে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল সংগ্রহ ব্যয় বেড়ে গেছে। আগে আমরা ব্যাংকের কাছ থেকে ৮-৯ শতাংশ সুদে তহবিল পেতাম। কিন্তু এখন ১৬ শতাংশ সুদেও ঋণ নিতে হচ্ছে। তাছাড়া ব্র্যাক ও আশার মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব তহবিলের আকার অনেক বড়।
‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করা দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যথায় মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল সংকটের কারণে বিপদে পড়বে। আর ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধও হয়ে যেতে পারে।’