ভ্যাট বন্ধু নিউজ প্রতিবেদক
১১ অক্টোবর, ২০২৪ | ৮:৩০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বিদ্যুতের মেগা প্রকল্পগুলোর চুক্তি ও অনিয়ম খতিয়ে দেখবে না পর্যালোচনা কমিটি
১১ অক্টোবর, ২০২৪ | ৮:৩০ পিএম
![বিদ্যুতের মেগা প্রকল্পগুলোর চুক্তি ও অনিয়ম খতিয়ে দেখবে না পর্যালোচনা কমিটি](https://i.vatbondhu.com/images/original-webp/2024/10/11/20241011124106_original_webp.webp)
ছবি: সংগ্রহ
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী, রামপাল ও পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি ও নির্মাণ নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও তা পর্যালোচনার আওতায় আসছে না
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০-এর অধীনে হওয়া চুক্তিগুলো খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দায়মুক্তি আইনে হওয়া আদানি, সামিটসহ ১১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য চেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। তবে মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী, রামপাল ও পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি ও নির্মাণ নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও তা পর্যালোচনার আওতায় আসছে না। বিশেষ আইনের আওতাধীন না হওয়ায় চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি এগুলো নিয়ে ভাবছে না বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। ফলে ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে এ চার প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে যেসব অভিযোগ রয়েছে, তা অগোচরেই রয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দরপত্র ছাড়া চুক্তি করতে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান)’ নামে আইনটি করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এ আইনের আওতায় প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুৎ, জ্বালানি কেনা ও অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ রাখা হয়। এমনকি এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। তাই এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, আইনটি কার্যকর হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৯১টি বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে, যার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে অনেকগুলো কেন্দ্রকে বসিয়ে রেখেই বিগত সরকার বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে, যা নিয়ে বেশ সমালোচনাও হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ আইনের আওতায় চুক্তিগুলো পর্যালোচনার যে উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার, তা প্রশংসনীয়। তবে বিদ্যুতের যেসব প্রকল্প নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়, সেগুলো হলো মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এসব প্রকল্পের ব্যয় ও নির্মাণ ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ফলে এ প্রকল্পগুলোর বিষয়ে যে ধরনের অস্বচ্ছতা ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোকে পরিষ্কার করা দরকার।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, ‘বিশেষ আইনের আওতায় যেসব প্রকল্প রিভিউ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে যেসব বৃহৎ ও মেগা প্রকল্প বিশেষ আইনের আওতায় নয়, সেগুলোর বিষয়েও বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর উদ্যোগ নেয়া দরকার। মানুষ যাতে বুঝতে পারে এসব প্রকল্প নির্মাণ ব্যয় কীভাবে হয়েছে। দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে দুই পক্ষের বসার সুযোগ তৈরি করে এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক কার্যকারিতার দিকগুলো তুলে ধরা গেলে সেখান থেকে অন্তত ব্যয় সাশ্রয়ের সুযোগ তৈরি হতে পারে।’
বিদ্যুৎ খাতের এ চার প্রকল্পের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি জিটুজি চুক্তির আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পে ৯০ শতাংশ অর্থায়ন, প্রযুক্তি ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়া। ২০১৬ সালে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণচুক্তি হয়। প্রকল্পের ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলারের মধ্যে রাশিয়া ঋণ হিসেবে দেয় ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় রূপপুরের এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। রাশিয়ার ঋণে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও শতভাগ মালিকানা বাংলাদেশের।
বিপুল টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পটির নিরাপত্তা ও ঝুঁকির বিষয়ে শুরু থেকে প্রশ্ন ছিল। সমালোচনা হয়েছে এর ব্যয় নিয়েও। এরই মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে নেয়া ঋণ নিয়ে নানা ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। যদিও ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল রাষ্ট্রদূতকে আশ্বস্ত করেছেন যে অন্তর্বর্তী সরকার রূপপুর প্রকল্পের অর্থ পরিশোধের বিষয়টি সমাধান করবে।
মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে রাশিয়ার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। চুক্তি মূল্যের ৯০ শতাংশ তথা ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার অর্থায়নে সম্মত হয় রাশিয়া। প্রকল্পের মূল ঋণের আসল পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালের মার্চ থেকে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ঋণ পরিশোধ শুরুর জন্য বাড়তি দুই বছর তথা ২০২৯ সাল পর্যন্ত গ্রেস পিরিয়ড চেয়েছে। এ বিষয়ে গত আগস্টে রাশিয়াকে চিঠি দেয়া হলেও কোনো জবাব আসেনি। তবে প্রকল্পের মূল ঋণের সুদ পরিশোধ ও প্রকল্প ঋণের বাইরে প্রাথমিক কাজের জন্য নেয়া ৫০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের সময় শুরু হয় গত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে দ্রুত আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে ঋণের অর্থ বন্ধ হয়ে যায়। এ অর্থ বিভিন্ন সময় দেশটি চীনা মুদ্রায় দিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানায়। যদিও বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হলেও নতুন জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
রাশিয়ার ঋণ পরিশোধে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়নায় হিসাব খোলার বিষয়ে সম্প্রতি সম্মতি পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে চীন চাইছে বাণিজ্যিক হিসাবের পরিবর্তে বিনিয়োগ হিসাব খোলা হোক। বিনিয়োগ হিসাব ব্যবহার করে আদৌ রাশিয়ার অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়েই মূলত তৈরি হয়েছে নতুন অনিশ্চয়তা।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে জাপানি অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৬ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা। যদিও এটি মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটির আওতাধীন। তবে মাতারবাড়ী বন্দরটি এখনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ ঋণ চুক্তি ও পরিশোধের হিসাব ধরতে হবে বিদ্যুৎ প্রকল্পটিকে ঘিরেই। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা এ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
দেশের প্রথম আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্র পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট (প্রথম পর্যায়)। আওয়ামী লীগ আমলে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিংয়ে নির্মাণ চুক্তি সই করেন। প্রকল্পটি সমান মালিকানায় যৌথ কোম্পানি বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারিজ ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি) যৌথভাবে এটি পরিচালনা করছে। প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।
জাতীয় চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির এসব প্রকল্প খতিয়ে দেখার সুযোগ রয়েছে কিনা সে বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দুজন কর্মকর্তা জানান, বিশেষ আইনের অধীনে নির্মিত যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনা করা হবে, সে তালিকায় পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ী ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। ফলে এগুলো পর্যালোচনা কমিটির আওতাধীন নয়। তবে এসব প্রকল্পের বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা কী তা নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি তারা।
![বিদ্যুতের মেগা প্রকল্পগুলোর চুক্তি ও অনিয়ম খতিয়ে দেখবে না পর্যালোচনা কমিটি](https://i.vatbondhu.com/images/original/2024/04/22/20240422145104_original.png)