ঢাকা শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৮:৪৮:৫৫ এএম

বৈদেশিক মুদ্রা আনছে মাছের আঁশ, ২৫০ কোটি টাকার বাজার

বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ২০০ কোটি টাকার মাছের আঁশ রপ্তানি হচ্ছে।

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ৭:০ পিএম

বৈদেশিক মুদ্রা আনছে মাছের আঁশ, ২৫০ কোটি টাকার বাজার

ছবি: সংগ্রহ

পাবনার সদর উপজেলার রানীগ্রামের মর্জিনা খাতুন (৫৫) বছর চারেক আগেও অন্যের বাড়িতে গৃহসহায়ক হিসেবে কাজ করতেন। তবে অভিনব এক উদ্যোগের সুবাদে এখন তিনি নিজেই উদ্যোক্তা। বাড়িতেই মাছের আঁশ আর বর্জ্যে করেছেন কর্মের সংস্থান। এখন আঁশ-বর্জ্য বিক্রির আয় দিয়েই চলে তার সংসার।

 

মর্জিনা জানান, এখন তার স্বামী ও প্রতিবন্ধী ছেলে স্থানীয় বাজারে মাছের ব্যবসা করেন। তারা বাজার থেকে মাছের ভেজা আঁশ আর বর্জ্য কিনে আনেন। সেগুলো পরিষ্কার করে শুকিয়ে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীদের কাছে। আঁশ বিক্রি করে তাদের মাসে ৩০ হাজার টাকার বেশি আয় হয়।

 

সেই অর্থে একসময়ের সহায়-সম্বলহীন মর্জিনা এখন জমি কিনে বাড়ি করেছেন। করছেন নিজের পুকুরে মাছ চাষ। বাড়ির উঠান ঘেঁষে কিনেছেন এক বিঘা জমিও। আগামীতে মাছের আঁশ ব্যবসার মাধ্যমে গ্রামের নারীদের কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখছেন মর্জিনা।

 

চার বছর আগে যশোরের এক ব্যবসায়ী অনুপ্রেরণায় আঁশ প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে যুক্ত হন মর্জিনা। তিনি জানান, শুরতে মাটিতে ফেলে চটের উপর আঁশ শুকাতেন। তখন আঁশের মান ভালো হতো না। দাম পেতেন কম। পরে স্থানীয় এনজিও প্রোগ্রাম ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের (পিসিডি) মাধ্যমে প্রশিক্ষণ, সহায়তা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করায় পণ্যের মান ভালো হয়। এখন দামও পান বেশি।

 

মাছের আঁশ রপ্তানি

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক জরিপে অনুসারে, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১৪.৯৯ মিলিয়ন ডলারের মাছের আঁশ ও বর্জ্য রপ্তানি হয়েছে, যার বেশিরভাগই মাছের আঁশ।

 

তারপর থেকে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ২০০ কোটি টাকার মাছের আঁশ রপ্তানি হচ্ছে। তবে ২০২০ সাল থেকে রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সালে রপ্তানি ১৭ মিলিয়ন ডলার বা ২০৬ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

 

প্রায় এক যুগ ধরে মাছের আঁশ কিনে দেশের বাইরে রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন যশোরের মো. কামরুজ্জামান। দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের সব জেলা থেকে তিনি মাছের আঁশ সংগ্রহ করেন। মাসে অন্তত ১০ টন আঁশ রপ্তানি করেন তিনি।

 

এই ব্যবসায়ী বলেন, আগে উদ্যোক্তারা মাছের আঁশ ভালোভাবে প্রক্রিয়াজাত করতে পারতেন না। এখন বহুমুখী প্রশিক্ষণের পর প্রায় সবাই ভালোভাবে আঁশ প্রক্রিয়াজাত করতে পারেন।

 

এসব আঁশহ কিনে নিয়ে কামরুজ্জামান বিভিন্ন পক্ষের মাধ্যমে চীন, জাপান ও কোরিয়ায় রপ্তানি করেন।

 

মাছের আঁশের বিশ্ববাজার

 

ভোলজা-র বৈশ্বিক আমদানি তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ৩৯ জন আন্তর্জাতিক ক্রেতার কাছে মাছের আঁশের ২০৮টি চালান রপ্তানি করেছে। ১৭ জন বাংলাদেশি রপ্তানিকারক এই আঁশ সরবরাহ করেছেন। এই হার আগের ১২ মাসের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি।

 

এই সময়ের মধ্যে শুধু ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসেই বিশ্ব বাংলাদেশ থেকে মাছের আঁশের ১২টি চালান নিয়েছে। এটি ২০২৩ সালের জানুয়ারির তুলনায় -৩৩ শতাংশ বেশি এবং ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি।

 

বিশ্বের বেশিরভাগ মাছের আঁশই চীন, ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে রপ্তানি হয়।


বিশ্বে মাছের আঁশের শীর্ষ তিন আমদানিকারক হলো যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও পেরু। ২ হাজার ১৮৪টি চালান নিয়ে মাছের আঁশ আমদানিতে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ৯৫৩টি চালান নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউক্রেন এবং ৬৮৬টি চালান নিয়ে পেরু আছে তৃতীয় স্থানে।

 

কর্মসংস্থানের সুযোগ

 

পিসিডির নির্বাহী পরিচালক মো. শফিকুল আলম বলেন, দেশের প্রায় সব এলাকায় মৎস্য বর্জ্য উৎপাদন হয়। এগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনা করলে পরিবেশের দূষণ কমে।

 

'প্রক্রিয়াজাতকরণ ও জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে একে মূল্যবান পণ্যে রূপান্তরিত করা সম্ভব। পিকেএসএফের রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্টের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে আমরা উদ্যোক্তাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আঁশ প্রক্রিয়াজাতকরণ করছি। এতে গ্রামীণ জনপদে তৈরি হচ্ছে বহু মানুষের কর্মসংস্থান,' বলেন তিনি।

 

সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণের পর স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে মাছের আঁশ প্রক্রিয়াজাতকরণ করছেন জয়পুরহাট সদরের শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা রুমি বেগম। তিনি এখন মাসে বিক্রি করছেন প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ কেজি আঁশ।

 

সংসার সামলানোর পাশাপাশি মাছের আঁশ বিক্রি করেই রুমি লাভ করছেন মাসে ১৫ হাজার টাকা। তার দেখাদেখি এলাকায় আরও পাঁচজন আঁশ প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে যুক্ত হয়েছে বলে জানান তুমি।

 

নাটোর জেলার বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দিক একসময় মাছের ব্যবসা করতেন। ২০১৮ সালের পর থেকে তিনিও মাছের আঁশ প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। জানালেন, নাটোর পৌরসভাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মাছের আঁশ আর বর্জ্য সংগ্রহ করে দিনে প্রায় ৬০ কেজি প্রক্রিয়াজাত করেন। মাসে প্রায় দেড় লাখ টাকার মাছের আঁশ বিক্রি করেন তিনি। ঢাকা-যশোরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এসে প্রক্রিয়াজতকারণ আঁশ কিনে নিয়ে যান তার কাছ থেকে।

 

কী আছে মাছের আঁশে?

মৎস্য গবেষকেরা বলছেন, সাধারণত একটা মাছের দৈহিক ওজনের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বর্জ্য হিসেবে ধরা হয়।

 

কৃষিবিজ্ঞানী ও মৎস্য গবেষকেরা বলছেন, মাছের শরীরজুড়ে বিস্তৃত আবরণ হলো আঁশ, যা মাছ কাটার পর সাধারণত ফেলে দেওয়া হয়। আগে এসব বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলে পরিবেশ দূষণ হতো।

 

কিন্তু এই মাছের আঁশ আর বর্জ্য অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই আঁশ আর বর্জ্য আমিষ ও ক্যালসিয়ামে ভরপুর। মাছের আঁশে সাধারণত ৬৫ থেকে ৬০ শতাংশ আমিষ ও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হাইড্রক্সিঅ্যাপাটাইট থাকে। দুটি উপাদানই মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

 

শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক কাজী আহসান হাবীব বলেন, মাছের আঁশ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কোলাজেন (সোডিয়াম, সালফার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে এতে), কোলাজেন পেপটাইড, হাইড্রোক্সিঅ্যাপাটাইট, জৈবসার, ওষুধের ক্যাপসুল আবরণ, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন প্রকার উচ্চমূল্য দ্রব্য ঊৎপাদন করা সম্ভব।

 

কোলাজেন হাড়, ত্বক ও প্রাণীর সংযোগকারী টিস্যুতে উপস্থিত একটি তন্তুযুক্ত প্রোটিন বলে জানান তিনি।

 

'মাছের আঁশ দেশে প্রক্রিয়াজাত করা গেলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে,' বলেন অধ্যাপক হাবীব।

 

দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির কাঠামো দৃঢ় করতে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁসহ ২৩ জেলার ৪৯টি উপজেলায় মাছ চাষ, মাছের আঁশ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্যোক্তা তৈরিতে দেশজুড়ে রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্টের মাধ্যমে উচ্চমূল্যের পণ্য তৈরি ও বাজারজাতকরণে কাজ করছে বিভিন্ন এনজিও।

 

এই খাতে দেড় লাখের বেশি মানুষ জড়িত রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি নারী। এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ডানিডা।

 

পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের জানান, দেশে মাছের আঁশের অর্থনৈতিক বাজার ২৫০ কোটি টাকার ওপরে। শত শত উদ্যোক্তা এই শিল্পের সাথে জড়িত।

 

তিনি বলেন, মাছের আঁশ দিয়ে চীনারা জিলাটিন তৈরি করে খাদ্য ও ওষুধ শিল্পে কাজে লাগায়। 'আমরা সেসব পণ্য ৬ গুণ দামে আমদানি করি।'

 

'তবে আশার কথা আমরাও মাঝারি পর্যায়ে উৎপাদনকারী তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। তাদের মাধ্যমে আগামীতে আঁশ থেকে দেশেই পণ্য তৈরি করতে চাই। এ শিল্পের জন্য স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে অনেকে আগ্রহও প্রকাশ করেছেন। এটি করা গেলে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে,' বলেন তিনি।

বৈদেশিক মুদ্রা আনছে মাছের আঁশ, ২৫০ কোটি টাকার বাজার