ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫ - ৪:১৭:০০ পিএম

ভারতে ২৮ শতাংশের বেশি কমেছে বাংলাদেশী পর্যটক

১৩ জানুয়ারি, ২০২৫ | ৭:০ পিএম

ভারতে ২৮ শতাংশের বেশি কমেছে বাংলাদেশী পর্যটক

ছবি: সংগ্রহ

জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন, সহিংসতা, কারফিউ, সর্বশেষ শেখ হাসিনার পতন—৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসা দেয়া সীমিত করে ভারত। এর প্রভাব পড়েছে দেশটির পর্যটন শিল্প ও ব্যবসায়। পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের তুলনায় গত বছরের একই সময়ে ভারতে বাংলাদেশী পর্যটক কমেছে ২৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। খাতসংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, উল্লিখিত সময়ে যারা গেছে তাদের বেশির ভাগের ভিসা আগের ইস্যু করা। নতুন করে ভিসা দেয়া সীমিত থাকায় সামনের দিনগুলোয় বাংলাদেশী পর্যটকের সংখ্যা আরো কমে আসবে ভারতে।


প্রতিবেশী ভারত ছাড়াও তুরস্ক, মিসর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশীদের ভিসাপ্রাপ্তি আগের তুলনায় কঠিন হয়েছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বেশকিছু দেশের ভিসা সেন্টার ভারতে হওয়ায় সেসব দেশের ভিসা পেতেও বেশ জটিলতায় পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশীদের। পাশাপাশি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিদেশী ও প্রবাসীদের যাতায়াত কমে যাওয়া, উড়োজাহাজ ভাড়া বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ ভ্রমণের হার কমেছে। বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যানেও। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরের তুলনায় ২০২৪ সালের একই মাসে সরকারের ভ্রমণ কর আদায় কমেছে ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ।


গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতে ভ্রমণ করা বিদেশী পর্যটকদের মধ্যে সংখ্যার দিক দিয়ে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশীরা। অক্টোবরে এসে অবশ্য সে অবস্থান দ্বিতীয়তে নেমে যায়। তবে শেখ হাসিনার পতনের মাস আগস্টে ভারতে বাংলাদেশী পর্যটক সবচেয়ে বেশি কমে। ওই মাসে দেশটিতে ভ্রমণ করেন ৯৯ হাজার ১৯৫ বাংলাদেশী, যা ২০২৩ সালের আগস্টের তুলনায় ৩৬ দশমিক ২৭ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বরে ভারত ভ্রমণ করে ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৬২ বাংলাদেশী। আর অক্টোবরে ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৫৮ বাংলাদেশী ভারতে যায়।

 

দেশের পর্যটন শিল্পের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) হিসাব অনুযায়ী, পর্যটন, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর আনুমানিক ৪০ লাখ মানুষ বিদেশে ভ্রমণ করে। এর মধ্যে কমবেশি ১৫ লাখ মানুষের গন্তব্য থাকে ভারত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশ ভ্রমণ কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ ভারতীয় ভিসা সীমিত হয়ে যাওয়া।

 

যাত্রী কম থাকায় ভারতগামী সাপ্তাহিক ফ্লাইটের সংখ্যা ৩২ থেকে ১০টিতে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশের বেসরকারি আকাশ পরিবহন সংস্থা ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস। সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন যারা ভারতে ভ্রমণ করছে, তাদের একটা বড় অংশই ৫ আগস্টের আগে ভিসা নিয়ে রেখেছিল। এ ধরনের ভিসাধারীদের সংখ্যা এখন কমে আসছে। সামনের দিনে কী হবে, তা আসলে আমরা জানি না।’

 

তিনি আরো বলেন, ‘‌আগে যখন ৩২টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হতো, তখন গড়ে ৭০ শতাংশের বেশি আসনে যাত্রী থাকত। এখন ফ্লাইটের সংখ্যা ১০টিতে নামিয়ে আনার পরও প্রায় অর্ধেক আসন ফাঁকা থাকছে।’

 

শুধু ইউএস বাংলা নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত আকাশ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ভারতে ফ্লাইট কমিয়েছে। কলকাতা রুটে ফ্লাইট বন্ধ রেখেছে আরেক বেসরকারি আকাশ পরিবহন সংস্থা নভোএয়ার।

 

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারত ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য গন্তব্যেও যাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টোয়াবের সাবেক সভাপতি ও অবকাশ পর্যটন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শিবলুল আজম কোরেশি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী পর্যটক উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ভারতীয় ভিসা বন্ধ থাকা। এছাড়া প্রত্যেক গন্তব্যেই বিমান ভাড়া ব্যাপক হারে বেড়েছে। কোনো কোনো গন্তব্যে ভাড়া বেড়ে দ্বিগুণও হয়েছে। এটাও একটা বড় কারণ। আরেকটা ইস্যু হলো ভিসা জটিলতা। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশের ভিসা পেতে বাংলাদেশীদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।’

 

তুরস্কের প্রায় ৮০ শতাংশ ভিসা ‘‌রিফিউজ’ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মিসরের ভিসা রিফিউজাল রেটও অনেক বেশি। থাইল্যান্ডের ভিসা পেতে ২৪ থেকে ৪৮ দিন পর্যন্ত সময় লাগছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর ভিসা পাওয়াও অনেক জটিল হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ থেকে ভিসাপ্রাপ্তি আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়েছে। এসবের বাইরে ভিসা ফিও একটা ফ্যাক্টর। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের জন্য ভিসা ফি ব্যাপক হারে বেড়েছে।’

 

প্রতি বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বেশকিছু দেশ এবং বিশ্বের আরো কিছু দেশের ভিসা সেন্টার ভারতে হওয়ায় সেখানে গিয়ে ভিসা সংগ্রহ করতে পারছেন না বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাওয়ার হার সাম্প্রতিক সময়ে কমে যাওয়ার পেছনে এ বিষয়কেও অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। আবার দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিদেশী ও প্রবাসীরা দেশে যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছেন। এটাও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

 

অন্যদিকে ভারতীয় ভিসা সীমিত হয়ে যাওয়ায় নেপাল, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, শ্রীলংকার মতো গন্তব্যগুলোয় বাংলাদেশীরা তুলনামূলক বেশি যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায় মিনিস্ট্রি অব ট্যুরিজম, শ্রীলংকার প্রকাশিত তথ্যে। দেশটির তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার ৭৩২ জন শ্রীলংকায় ভ্রমণ করেন, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৫২ শতাংশ বেশি।

 

দেশের ভেতরে কিংবা বিদেশে যেতে বিমানে উঠলেই ভ্রমণ কর দিতে হয়। স্থল, রেল ও নৌপথে বিদেশ যেতেও দিতে হয় ভ্রমণ কর। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের অক্টোবরে ভ্রমণ কর আদায় হয়েছে ১৭৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ২১২ কোটি টাকা ভ্রমণ কর আদায় করেছিল এনবিআর। এক বছরের ব্যবধানে তা কমেছে ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

 

অক্টোবরে ভ্রমণ কর আদায় কমলেও বিষয়টিকে সাময়িক হিসেবে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া। এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌সাম্প্রতিক সময়ে আকাশপথে যাত্রীর সংখ্যা কিছুটা ড্রপ করেছে। বিভিন্ন প্রেক্ষিত, বিভিন্ন কারণ এর জন্য দায়ী। তবে এটা সাময়িক। দ্রুতই যাত্রীর সংখ্যা আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্য যাত্রীর সংখ্যা কিছুটা কমে যাওয়ায় হয়তো রাজস্ব আদায় কমে এসেছে। আবার এখন বাড়তে শুরু করেছে। তবে আমাদের কাছে যে হিসাব আছে, আগের বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে যাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিল।’

ভারতে ২৮ শতাংশের বেশি কমেছে বাংলাদেশী পর্যটক